প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্যে অবৈধ অভিবাসীদের মনে আশার সঞ্চার
অভিবাসন ও ভিসা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে ব্রিটেনে
যুক্তরাজ্যের নতুন এই সিস্টেম হবে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা সিস্টেমের অনুকরণে
যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসনের মূল মনোযোগ ব্রেক্সিট-এ। বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে প্রথম ভাষণে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়া (ব্রেক্সিট) নিশ্চিতে কাজ করার কথা জানান তিনি। এছাড়া ওই ভাষণে দেশের অভিবাসন ও ভিসা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার কথা জানিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে প্রথমবার ভাষণ দেন যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
হাউস অব কমন্সে আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে বরিস জনসন বলেন, আমরা আরও নিশ্চিত করতে চাই যে আমরা সারা বিশ্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও মেধাবীদের আকৃষ্ট করা অব্যাহত রাখবো। অভিবাসন থেকে আমাদের দেশের সুবিধা পাওয়ার কথা আমার চেয়ে কেউ বেশি জোরালোভাবে বিশ্বাস করে না। তবে আমি পরিস্কার করতে চাই যে আমাদের অভিবাসন ব্যবস্থা অবশ্যই পরিবর্তন করতে হবে।
বহু বছর ধরে রাজনীতিবিদরা অস্ট্রেলিয়ার মতো পয়েন্ট ভিত্তিক ব্যবস্থা প্রণয়ণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’। জনসন বলেন, ‘আর আজ আমি সত্যিকার অর্থে ওই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- আমাদের অভিবাসন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আমি অভিবাসন উপদেষ্টা কমিটিকে প্রচলিত ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করতে বলবো। আমি বিশ্বাস করি যে আমরা এমন একটি সিস্টেম তৈরি করতে পারবো যাতে ব্রিটেনের জনগণ বিশ্বাস করতে পারে’। যুক্তরাজ্যের নতুন এই সিস্টেম হবে অস্ট্রেলিয়ার ভিসা সিস্টেমের অনুকরণে। এই সিস্টেমে আবেদনকারীর যে কোনও একটি দক্ষতার ওপর জোর দেওয়া হয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের অভিবাসীরা এর লক্ষ্য হবে।
এদিকে বরিস জনসন ক্ষমতায় আসার পর নতুন একটি মন্তব্য দেশটিতে বসবাসরত অবৈধদের জন্য আশাব্যাঞ্জক। ব্রিটেনে বসবাসরত এক লাখেরও বেশি অনথিভুক্ত বাংলাদেশি অভিবাসী সেখানে বসবাসের বৈধতা পেতে যাচ্ছেন বলে আশ্বাস মিলেছে। বৃহস্পতিবার দেশটির পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুপা হকের এক প্রশ্নের জবাবে নতুন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানিয়েছেন, অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বৈধতার প্রশ্নে তার সরকার নীতিগতভাবে আন্তরিক।
উল্লেখ্য, লন্ডনের মেয়র থাকাকালে জনসন দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ৫ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বৈধতা দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশিদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, এক লাখেরও বেশি অনথিভুক্ত বাংলাদেশি রয়েছেন। বছরের পর বছর ধরে তারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন।
২০০৯ সালে লন্ডনের মেয়র থাকাকালে জনসন সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেছিলেন, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা ব্রিটেনে অবৈধভাবে বসবাস করছেন তাদের বৈধতা দিয়ে আইনের আওতায় নিয়ে আসলে একদিকে বৈধ শ্রমিক সংকটের সুরাহা হবে, অপরদিকে তাদের আয় থেকে সরকারি কোষাগারে কর জমা পড়ার পরিমাণ বাড়বে।
এতে দুই পক্ষই লাভবান হবে। বুধবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে জনসনের সেই আহ্বানের কথা সামনে এনে লন্ডনের ইলিং এলাকা থেকে নির্বাচিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুপা হক তার উদ্দেশে বলেন, এখন তো আপনি প্রধানমন্ত্রী, এখন কি অনথিভুক্তদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে আপনি প্রমাণ করবেন যে আপনার কথার সঙ্গে আমার কাজের মিল রয়েছে?
রূপার প্রশ্নের জবাবে বরিস জনসন বলেন, এটা সত্যি। আমি সরকারে থাকাবস্থায় বিষয়টি কয়েকবার উত্থাপন করেছি। তবে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও উত্থাপন করলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা পাইনি।
তিনি বলেন, ব্রিটেনে বসবাসরত অনথিভুক্ত প্রায় পাচঁ লাখ মানুষকে এদেশ থেকে বের করে দিতে চায় সরকার। তবে তাদের বিষয়টি দেখা উচিত। আর এই বিষয়টি সরকার নীতিগতভাবে আন্তরিক বলেও দাবি করেন তিনি।
বরিস জনসন বলেন, যারা কোনও অপরাধে না জড়িয়ে বছরের পর বছর এখানে বসবাস করছেন আমার মনে হয় আইনিভাবে তারা সঠিক অবস্থানেই আছেন। তাদের নিয়ে অনেক জটিলতার ব্যাপার রয়েছে। যেমনটা আমরা দেখেছি উইন্ডরাশ এর ঘটনায়। আমি রুপা হকের প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দিতে চাই। হ্যাঁ, আমি মনে করি, যারা এদেশে বছরের পর বছর কোন অপরাধে না জড়িয়ে বসবাস করছে, কাজ করছে কিন্তু ট্যাক্স দিতে পারছে না, তাদের বিষয়টি দেখা উচিত। সত্যি বলতে আইন ইতোমধ্যেই তাদের থাকার অধিকার দিয়েছে। রুপা হক যেই নীতির কথা বলছেন তার আগে, তাদের সাধারণ ক্ষমা দেওয়ার আগে আমাদের অর্থনৈতিক সুবিধা অসুবিধা দেখতে হবে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই ব্রিটেনে বসবাসকারীদের সাধারণ ক্ষমার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বৃহস্পতিবারের বক্তব্য খুব আশাব্যাঞ্জক। তাতে মনে হয়েছে দ্রুতই সমাধান বা সুখবর হতে পারে। এতে বছরের পর বছর ধরে এখানে বসবাসরত এক লাখেরও বেশি অনথিভুক্ত বাংলাদেশির বৈধভাবে বসবাসের সুযোগ মিলবে।
উল্লেখ্য, ২০০০ সালে ওভার স্টেয়ার রেগুলেশন ২০০০ নামে আইন করে স্বরাষ্ট্র দফতর নীতিমালার মধ্যে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের ব্রিটেনে বসবাসের সুযোগ দিয়েছিলো।
তারপর জুলাই ২০০৬ সালে আটকে পড়া ৪ লাখ ৫০ হাজার ফাইলের ওপর ৫ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা স্বরাষ্ট্র দফতর গ্রহণ করেছিলো, যা বহুলভাবে লিগ্যাসি নামে পরিচিত। তার মধ্যে ১ লাখ ৬১ হাজার (একশত একষট্টি হাজার) মানুষকে বিভিন্নভাবে বৈধতা দেওয়া হয় এবং ফাইলগুলো বিভিন্ন জটিলতার কারণে প্রত্যাখান করে ২০১১ সালে লিগেসির পরিসমাপ্তি ঘটে।
এর আগে ২০১০ সালের ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির তৎকালীন প্রধান নিক ক্লেগ ব্রিটেনে অবৈধভাবে বসবাসকারীদের বিভিন্ন শর্তের মাধ্যমে বৈধতা প্রদানের প্রস্তাব করেছিলেন, যার নাম ছিলো রুট টু সিটিজেনশিপ।
তার প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো ছিল, আবেদনকারীকে যুক্তরাজ্যে অন্তত ১০ বছর বসবাসের প্রমাণ থাকতে হবে এবং কোন অপরাধের রেকর্ড থাকা যাবে না। আবেদনকারীকে অবশ্যই ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী হতে হবে। এছাড়া তাকে একটি নির্ধারিত পদ্বতিতে নাগরিকত্ব অর্জনের নীতিমালা প্রদান করা হবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেটা পূরণ করতে হবে।