ব্রিটেনে এশীয় এবং মুসলিমরা ভয়াবহ যৌন নিপীড়নের শিকার
ফারহার এখন বয়স ১৩। কিন্তু এরও আগেই তার জীবনে ঘটে গেছে দুঃসহ এক ঘটনা। বয়ঃসন্ধির আগেই বয়স্ক ছেলে বন্ধুর বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছে সে।
এখানেই শেষ নয়, একান্ত মুহূর্তের কিছু ছবি তুলে তাকে ব্লাক-মেইল করে ওই বন্ধু। এরপর সে ও তার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত ফারহাকে দৈহিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করে।
ফলে তের বছর বয়সে ফারাহ এখন বিভিন্ন নেশাজাতীয় মাদকে আসক্ত। আসক্তির কারণ নিয়মিত একাধিক পুরুষের বেডে যেতে হচ্ছে তাকে। এভাবে যৌন নিপীড়িত হয়ে নিজে ছেলে বন্ধুর অর্থ উপার্জনেরও অন্যতম মাধ্যম ফারাহ।
এ রকম শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন পৃথিবীর যেকোনো সমাজেই আতঙ্কজনক। কিন্তু ফারাহ (ছদ্মনাম) একজন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত যুক্তরাজ্যের নাগরিক। তার এবং তার মত অন্যান্য সংখ্যালঘু মেয়েদের জীবনের গল্প নিয়ে প্রকাশিত আল-জাজিরার প্রতিবেদনটি সবাইকে নাড়া দিয়েছে।
এতে স্পষ্ট হয়েছে, সমাজের সবচেয়ে বঞ্চিত অংশ বিশেষ করে এশীয় ও মুসলিম নারীরা যুক্তরাজ্যে কতটা অসহায় এবং দেশটির প্রশাসন এসব বঞ্চিতদের রক্ষায় কতটা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে কয়েকটি কেস স্টাডি তুলে ধরা হয়েছে। তবে বাস্তবে আরও ভয়াবহ চিত্র দেখতে পেয়েছেন ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদকরা।
ওই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের মেয়েরা কি ধরনের সমস্যায় পড়ে এবং তাদের ওপর বিভিন্ন সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধী চক্র কিভাবে যৌন নির্যাতন চালিয়ে আসছে তার ওপর বিস্তর গবেষণা চালানোর জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
মুসলিম ওমেনস নেটওয়ার্ক ইউকে (MWNUK)- তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ওই প্রতিবেদনটির লেখিকা শাইস্তা গোহির বলেন, ‘এ প্রতিবেদনে শিশুর ওপর যৌন নির্যাতনের গৎবাঁধা ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এখানে যৌন নিপীড়নকে একটি বর্ণবাদী ব্যাপার হিসেবে দেখানো হয়েছ। এতে করে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, এশীয় অপরাধীরাই শুধু শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের টার্গেট করে। কখনো এশিয়ান ও মুসলিম নারীরা অন্যদের যৌন নির্যাতনের শিকার হয় না।’
তিনি বলেন, ‘তবে আমাদের প্রতিবেদন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে, দেশটিতে এশিয়ান ও মুসলিমরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।’
মুসলিম ওমেনস নেটওয়ার্ক ইউকে’র আরেকটি প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, ‘নিপীড়করা ১৩-১৪ বছরের এশিয়ান ও মুসলিম মেয়েদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়ে আসছে। অথচ ব্রিটিশ প্রশাসন ও গণমাধ্যমে এতদিন সংগঠিত এশিয়ান অপরাধী পুরুষরাই কেবল শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে থাকে বলে প্রচার করে এসেছে। এখন এ প্রতিবেদনে তথ্য তাদের এই গৎবাধা প্রচারণার ওপর চরম চপেটাঘাত।’
ব্রিটেনের শিশুবিষয়ক কমিশনের ডেপুটি কমিশনার স্যু বারলুউইটজ বলেন, ‘মুসলিম ওমেনস নেটওয়ার্ক ইউকে’র প্রতিবেদনটি অত্যন্ত সাহসী একটি পদক্ষেপ। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এটি এতদিনের প্রচলিত কল্পকাহিনীর ওপর চরম চপেটাঘাত।’
তিনি বলেন, ‘ওই প্রতিবেদনে কিছু আক্রান্তদের গল্প এখন পর্যন্ত আমার জানা ঘটনাগুলোর মধ্যে খুবই ভয়াবহ। অন্যান্য শিশুদের মত এশিয়ান এবং মুসলিম শিশুরাও যৌন নির্যাতনের দারুণ হুমকিতে রয়েছে।’
‘আনহেয়ার্ড ভয়েসেস’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে দেখানো হয়, এশিয়ান নারীরা যৌন নিপীড়কদের সবচেয়ে সহজ শিকার হতে পারে। এ এই শিকার হয় কারণ তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মানসই অন্যদের থেকে ভিন্ন। ফলে টার্গেট করা সহজ হয়।
সঙ্ঘবদ্ধ চক্রের নিপীড়ন
শিশু নিপীড়নের ইস্যুটা ব্রিটেনের রাজনীতিতে কয়েক বছরের আলোচিত ইস্যু। একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১০ সালের আগস্ট থেকে ২০১১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৪০৯ জন শিশু, তরুণ-তরুণী বিভিন্ন গ্যাং ও দলের যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
এতে বলা হয়, ২০১০ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সালের মার্চ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে ১৬ হাজার ৫০০ জন শিশু উচ্চতর ঝুঁকিতে ছিল। সেখানে এশিয়ান মুসলিম, হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়, পাকিস্তানি, ভারতীয়, বাংলাদেশি, সোমালীয় ও আফগানিদের ওপর বিভিন্ন সঙ্ঘবদ্ধ শ্বেতাঙ্গ অপরাধীরা যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে।
আক্রান্ত কয়েকজনের একজন ইমান, খুবই অল্প বয়সে সে তার বাবার হাতে নিগৃহীত হয়। এরপর তার কোরআন শিক্ষকের হাতে। আইশা ৬ বছর বয়সে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় এবং পরবর্তীতে তাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে যৌনতার দীক্ষা দেয়া হয়।
সাফা ১৪ বছর বয়সে এক চাচার পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয় এবং চাচার বন্ধুদের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হয়। নাজিয়া এক ছেলে বন্ধুর মাধ্যমে হেরোইনে আসক্ত হয় এবং তার মাধ্যমে পতিতাবৃত্তিতে নামে। একটি বয়স্ক ছেলে ১০ বছর বয়সী হাসিনা নামের আরেকটি মেয়েকে যৌনকর্মে প্রলুব্ধ করে। তারপর আরও একদল তরুণের সঙ্গে তাকে যৌন সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হয়।
এভাবে পারভীন নামের আরেকটি মেয়ে ১২ বছর বয়সে তার সৎ-বাবার ভাই ও তার এক বন্ধুর ব্লাক-মেইলের শিকার হয়ে তাদের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীতে তাদের বন্ধুরাও একই কাজে তাকে বারংবার বাধ্য করছে।
এছাড়া ওই প্রতিবেদনে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়েছে, কিভাবে পরিবারের অন্য নারী সদস্যরা একান্তই পরিবারের দুর্নামের ভয়ে এসব অপরাধ না দেখার ভান করে থাকে।
শাইস্তা গোহির বলেন, ‘আশ্চর্যের বিষয় হলো- বেশিরভাগ যৌন নিপীড়নের অভিযোগের তীর তারই পরিবারের কোনো সদস্যের দিকে। অথচ এই ব্যাপারটিই আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আক্রান্তরা একই সম্প্রদায়ের পুরুষ অথবা বয়স্ক ছেলে বন্ধুর কাছে প্রথম নিপীড়নের শিকার হয়। তারপর ওই ছেলে বন্ধুর অন্য বন্ধুদের মাধ্যমে। কিছু ক্ষেত্রে বয়স্ক পুরুষরা কিছু ছেলেকে ওইসব মেয়ের প্রতি খেয়াল রাখার জন্য অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দিয়ে থাকে। এরপর ওই ছেলেরা তাদের সঙ্গে ওই মেয়েদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
এ বিষয়ে গোহির বলেন, ‘একটা মেয়ে আমাকে বললো- কিছু ট্যাক্সি ড্রাইবার ওদের স্কুলের আশেপাশে ঘুরাঘুরি করে এবং সুন্দরী মেয়েদের খোঁজ করে। মেয়েদের বাসায় যাওয়ার পথ চিনে ওই মেয়ের বয়সী কোনো কাজিন বা প্রতিবেশী ছেলের সঙ্গে পরিচিত হয়। এরপর সমবয়সী অন্য কোনো ছেলেকে ওই টার্গেট করা মেয়ের সঙ্গে কথা বলানো, একে অন্যকে জানার ব্যবস্থা করানো হয় এবং মেয়েটির ছেলে বন্ধু বানানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এগুলোর সব থাকে পূর্বপরিকল্পিত ফাঁদ।’
তাদের এ ফাঁদ অনেক সময় এতটাই ভয়ঙ্কর যে, কোনো মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করার সময় অ্যালকোহল এবং নেশাজাতীয় পণ্য ব্যবহার করা হয়, যাতে আক্রান্ত মেয়েটি পরবর্তীতে কোনো অভিযোগ করতে না পারে।
প্রতিবেদনেতে যৌন নির্যাতনের বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেদনটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- সংখ্যালঘু যৌন নিপীড়নের প্রধান হাতিয়ার ‘ব্লাক-মেইল’ বা প্রতারণা। যেখানে অপরাধীরা পরিবারের লজ্জা ও মানহানির ভয় দেখিয়ে আক্রান্ত শিশুদের নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তাছাড়া ওইসব পরিবারেও শিশু নিপীড়নের বিষয়টা বিশ্বাস করা হয় না অথবা উড়িয়ে দেয়া হয়। আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা এজন্য সব সময় হুমকিতে থাকে।
মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল ড. দাউদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকে মূলত তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান ও সাংস্কৃতিক কারণে। যারা আক্রান্ত হয় তারা এ ব্যাপারগুলো জানাতে অনিচ্ছুক থাকে অথবা জানে না কোথায় জানাতে হবে। এ কারণে তারা আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ে।’
‘আনহেয়ার্ড ভয়েসেস’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, যৌন নিপীড়নের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন পুরুষ প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেমন- ফারহার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের জন্য বেছে নেয়া পবিত্র রমজান মাসকে।
দুজন পাকিস্তানি মেয়েকে দৈহিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করা হয় দুজন জোব্বাধারি বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে, যাদের প্রথম দেখাতেই খুব ধার্মিক বলে মনে হবে।
ওই প্রতিবেদনে জোর দিয়ে দেখানো হয়েছে, কিভাবে মূলধারার গণমাধ্যম, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পুলিশ সাংস্কৃতিক বৈষম্যের কারণে বিষয়টিতে নজর দিতে পারছে না এবং আক্রান্ত মেয়েদের কোনো সাহায্যে আসতে পারছে না।
শিশুদের প্রধান দাতব্য সংস্থা এনএসপিসিসি’র জন ব্রাউন বলেন, ‘মনে রাখতে হবে অপরাধীরা তাদেরই টার্গেট করে, যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করে সহজেই পার পাওয়া যাবে এবং তাদের দীর্ঘদিন এই মায়াজালে আটকে রাখা যাবে।’
তিনি বলেন, ‘তাছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের শিকার মেয়েরা মূলধারার গণমাধ্যম ও প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাহায্য পাচ্ছে না বা পায়নি। সেজন্য তারাই বেশি এই বিকৃত যৌনাচারের শিকার হচ্ছে।’