সিলেটে নতুন পর্যটন স্পট বুজির বন
আবুল কালাম, সিলেট থেকে ফিরে: সিলেটে নতুন করে সন্ধান মিলেছে দৃষ্টিনন্দন আরেকটি পর্যটন স্পটের। নাম বুজির বন! নিসর্গের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অপরূপ বন। সিলেটের জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার একেবারে প্রান্তসীমায় এক নির্জন স্থানে তার অবস্থান। এ বনটি যেন নিসর্গের এক আদর্শ উদ্যান। বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বুজির বন একটি ‘সোয়াম্প বন’। তিন নদীর মিলনস্থলে প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো বনটি আবহমানকাল থেকে এখনো টিকে আছে। করিচ ও কাঁপনা নদী চলে গেছে এ নদীর বুক চিরে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে পুড়াখাই নদীর একটি শাখা।
সিলেট-তামাবিল সড়ক ধরে হরিপুরের পরেই করিচ ব্রিজ। সে সেতু থেকে পশ্চিম দিকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই বনটির অবস্থান। ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা আর দুর্গমতার কারণে এমনটি হয়েছে বলে মনে হয়। বনের বুক চিরে চলে যাওয়া নদীপথে গেলে দেখা যায়, হিজল-করচ-জারুল-বরুন-শেওড়া-বুরি আর কদমের লম্বা লম্বা সারি। গাছগুলো একটি আরেকটিকে ঘিরে ধরেছে। শতবর্ষী একেকটি হিজলগাছ নিজের ডালপালা আর পাতা দিয়ে অনেক জায়গাজুড়ে অবস্থান করছে। প্রবল বর্ষায় সে যেন নবরূপে জেগে ওঠে। বনের বিচিত্র সব গাছ, জলচর-স্থলচর-উভচর প্রাণী আর মাছ শিকারীদের নিয়ে তার নিজের একান্ত ভুবন। শতাব্দীর পর শতাব্দী কিভাবে এটি যে পর্যটকদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গেছে সে এক রহস্য।
বৈশিষ্ট্যগত দিক দিয়ে বুজির বন একটি থ‘সোয়াম্প বন’। পানিকে কেন্দ্র করে বনটির ’ইকোসিস্টেম’ তথা পুরো অস্তিত্ব নির্ভরশীল। সিলেটের জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার একেবারে প্রান্তসীমায় অনেকগুলো হাওরের মধ্যে এক নির্জন স্থানে এর অবস্থান।
বনের ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায়, মুর্তা, বেত, হোগলা আর শনের ঘন জঙ্গল। বড়গাছগুলোর নিচের এসব ঝোপঝাড় দেখলে মনে হতে পারে, ছোট গাছগুলোকে যেন এরা মায়ের মতো আদরের চাদরে ঢেকে রেখেছে। সন্ধ্যার আলো-আঁধারীতে এক একটি হিজল গাছকে মনে হয় গভীর ধ্যানে মগ্ন একেকজন দরবেশ। বনের পশ্চিম-উত্তর দিকে রয়েছে ইকড়ের বিশাল হাওর। দিগন্তের ওপারে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের হাতছানি মনকে আকুল না করে পারে না।
বুজির বন জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি বন। বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদ, জলচর ও স্থলচর প্রাণীর এক সমৃদ্ধ আবাসস্থল। বনের মধ্যে দেখা মেলে উদবিড়াল, গেছো ইদুর, কাঠবিড়ালী, খেকশিয়ালসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। অনেক মেছোবাঘও বনে বাস করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জেলেরা। চিল, ঈগল, ডাহুক, কানাবক, বালিহাস আর নানা প্রজাতির পাখির আশ্রয় এই বনে। বিশেষ করে, শীতকালে পরিযায়ী পাখির কলকাকলীতে মুখর থাকে এ বন। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছে ভরপুর বনটি। স্থানীয় জেলেরা এ বনের মধ্যে নানা প্রকার ফাঁদ পেতে মাছ শিকার করে।
এত আকর্ষণের পরও বন বিভাগের নথিপত্রে বনটির কোনো অস্তিত্ব নেই। অবশ্য ২০ একরের ঊর্ধ্বে জলমহালের একটি তালিকায় বুজির বিল নামে একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যায় যেটি জৈন্তাপুরের ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। প্রাচীনকালের কোনো এক সময়ে প্রকৃতি যেভাবে এটিকে গঠন করেছিল, আজো বনটি সেভাবে আছে। নিজের অফুরন্ত সম্পদ দিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি মানুষের প্রয়োজন মিটিয়েছে, ভারসাম্য রক্ষা করেছে পরিবেশ ও প্রকৃতির। হেমু নামক গ্রামটির মানুষের কাছে বনটি সুপরিচিত হলেও বাইরের মানুষের কাছে এটি অজানা রয়ে গেছে।