এক দশক পূর্ণ করল বিস্ময়কর চালকবিহীন দুবাই মেট্রো ট্রেন

ক্যালেন্ডারের পাতায় ২০০৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ৯/৯/৯ ৯:৯:৯ অর্থাৎ রাত ৯টা ৯ মিনিট ৯ সেকেন্ড, দুবাইর মল অব এমিরেটস স্টেশনে ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে প্রবেশ করলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মকতুম। যাত্রা শুরু করলো বিশ্বের দীর্ঘতম চালকবিহীন মেট্রো ট্রেন ‘দুবাই মেট্রো।

হাজার হাজার আতশবাজির রঙিন আলোয় ঝলমল করে উঠলো দুবাইয়ের আকাশ। নির্দিষ্ট নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে অপেক্ষমান হাজারো মানুষের করতালি আর গাড়ির হর্ণের শব্দে মুখরিত হয় উঠলো মধ্যপ্রাচ্যের সর্বজনীন নগরী দুবাই। দুবাই মেট্রো উদ্বোধনের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবেশ করলো পরিবহণ প্রযুক্তির এক নতুন যুগে।

দুবাই মেট্রো সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুবাইর পর্যটকদের আকর্ষণ ও দ্রæত যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত পাবলিক পরিবহন। দুবাই মেট্রো সংযুক্ত আরব আমিরাত তথা আরব উপদ্বীপের মধ্যে একেবারে নতুন পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা। যা দুবাইর যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। লাল এবং সবুজ দুটি লাইন বা রুট মিলে প্রায় ৭৫ কি.মি. রাস্তার এই বাহনটি বর্তমান বিশ্বের দীর্ঘতম ড্রাইভার বিহীন মেট্রো হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান করে নিয়েছে। আর দুবাইর অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

৯টি ভূগর্ভস্থ স্টেশনসহ ৪৭টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেশন নিয়ে ‘দুবাই মেট্রো’ যাত্রা শুরু করে। সম্পূর্ণ অটোমেটিক পদ্ধতির এই বাহনটি শুরু থেকেই আরব আমিরাতের স্হানীয় অধিবাসী, পর্যটকসহ সবার মন জয় করে নিয়েছে। প্রায় ৫৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় (২ হাজার ৮০০ কোটি আরব আমিরাত দিরহাম) দুবাই মেট্রো নির্মিত হয়েছে মাত্র ৪ বছরে।

৩০ হাজার শ্রমিকের অক্লান্ত পরিশ্রমে বিশ্বখ্যাত ৫টি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও প্রায় দেড়শ’ সহযোগী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয় ৭৪.৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ রেললাইন। এ ট্রেন ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর দুবাই শহরে ট্রাফিক জ্যামের কারণে ক্ষতি হওয়া ৫ বিলিয়ন দিরহাম সাশ্রয় হচ্ছে দুবাই সরকারের। উদ্বোধনের পর থেকে ১০ বছরের জন্য দুবাই মেট্রো পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পেয়েছে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ‘সারকো’। ৩ হাজারেরও বেশি সিকিউরিটি ক্যামেরায় নজরদারি ও নিরাপত্তার দায়িত্বে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত আছে ছয় শতাধিক সদস্যের বিশেষ পুলিশ বাহিনী।

দুবাই মেট্রোর প্রথম দুটি লাইন গ্রীন লাইন ও রেড লাইনের স্টেশন সমূহ দুবাইর গুরুত্বপূর্ণ স্হান কেন্দ্রিক। রেড লাইনের স্টেশন সমূহের মাঝে রয়েছে ইবনে বতুতা মল, দুবাই মেরিনা, মল অফ ইমিরাত, দুবাই মল, বুর্জ খলিফা, দুবাই এয়ারপোর্টের মতো বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র। অন্যদিকে গ্রিনলাইনের স্টেশন সমূহের মাঝে রয়েছে পুরান দুবাইর , অনেক ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্হান সমূহ যেমন দুবাই ক্রিক, হেলথ কেয়ার সিটি, দুবাই জাদুঘর, গোল্ড স্যুক, আল ফাহিদী পোর্টসহ বেশ কয়েকটি স্টেশন।

প্রথম দুটি মেট্রো লাইন ছাড়াও রুট ২০২০ যা নির্মাণাধীন, ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ লাইনে এক্সটেনশানসহ ৭টি নতুন স্টেশন যার মাঝে ২টি ভূগর্ভস্থ স্টেশন নির্মিত হচ্ছে, নাখিল হারবার টাওয়ার স্টেশন থেকে শুরু হয়ে এক্সপো ২০২০ সাইটে এ লাইন শেষ হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে প্রস্তাবিত নীল এবং বেগুনি নামে আরো ২টি লাইন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে, যা আল মাকতুম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত প্রসারিত হবে।

মাটি, বাতাস, পানি এবং আগুন প্রকৃতির এ চারটি মূল উপাদান মাথায় রেখে এ ট্রেনের বিভিন্ন স্টেশন এবং কম্পার্টমেন্টগুলো ডিজাইন করা হয়েছে, বর্ণাঢ্য নান রঙ, স্থাপত্য আর আধুনিকতার ছোঁয়ায়। রেড ও গ্রীন লাইনের ২টি রুটের সংযোজক বাস যাত্রীদের সুবিধার্থে নির্মাণ করা হয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস স্টপেজ।

প্রতিটি স্টেশনই খুবই সুসজ্জিত, বিশ্রাম নেয়ার চেয়ার ও ওয়াস রুমের ব্যবস্হা রয়েছে সবগুলো স্টেশনে। প্রতিটি মেট্রো ট্রেন, স্টেশন ও প্লাটফর্ম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। স্টেশনগুলো নান্দনিক সব শিল্পকর্মে সাজানো। আরবীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যেরে নানার ঘটনার ছবির ছোঁয়া, ট্রেনের গায়ে এরাবিক ক্যালিগ্রাফি পর্যটকদের মন কাড়ে খুবই সহজে। মেট্রোর সব কিছু অটোমেটিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

স্টেশনে প্রবেশের মূল ফটক, কার্ড পাসিং, মেট্রোর গেটসহ সব প্রবেশ পথ অটোমেটিক। রয়েছে লিফটের মাধ্যমে ওপরে ওঠা বা ভূগর্ভস্থ স্টেশনের নিচে যাওয়ার জন্য চলন্ত সিঁড়ি ও ইলেক্ট্রিক লিফট ব্যবস্থা। ক্যাশ বা নগদ টাকার কোন লেনদেন না থাকায় ভাড়া পরিশোধ করতে হয় এক ধরনের ইলেকট্রনিক কার্ড এর মাধ্যামে। বুথ বা মেশিনের সাহায্যে এ কার্ড রিচার্জ করা যায় খুব সহজে। বুথ ছাড়াও কার্ড রিচার্জের জন্য যাত্রীদের সুবিধার্থে রয়েছে টিকিট কাউন্টারের বিশেষ সুবিধা।

দুবাই মেট্রোর প্রত্যেকটি ট্রেনে তিনটি করে ক্লাস রয়েছে। ভিআইপিদের জন্যে গোল্ডেন ক্লাস, মহিলা ও শিশুদের জন্যে ওমেন এন্ড চিলড্রেন ক্লাস এবং সাশ্রয়ী ভাড়ায় সিলভার ক্লাস। টাকা থাকলে যে কেউ ভিআইপি বা গোল্ডেন ক্লাস ব্যবহার করতে পারেন, এক্ষেত্রে সিলভার ক্লাসের চাইতে দ্বিগুণ ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। এছাড়া বৃদ্ধ ও গর্ভবতী নারীদের জন্য অগ্রাধিকার আসনের বসার ব্যাবস্থা রয়েছে।

মেট্রোর প্রত্যেক কম্পার্টমেন্টে প্রতিবন্ধীদের জন্যে রয়েছে আলাদা আসন। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা, সমস্ত মেট্রো স্টেশনগুলিতে প্রতিবন্ধীদের গাইড করার জন্য লিফট, মেট্রোতে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের জন্য রয়েছে আলাদা জায়গাসহ বিশেষ সুবিধা।
প্রতিদিন ভোর ৫.৩০ থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতি ৫ মিনিট অন্তর ট্রেন চলাচল করে, ব্যস্ত সময়ে ৩ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড অন্তর ট্রেন চলাচল করে। প্রতি স্টেশনে ৩০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট থামে এ ট্রেন। বিশেষ কোন সরকারী ছুটির দিনে ট্রেন চলাচলের সময় পরিবর্তন করা হয়। ছুটির দিনে ২৪ ঘন্টা ট্রেন চলাচল করে। পাবলিক পরিবহন হলেও মেট্রোর ভেতরে খাওয়া-পানীয়সহ ধূমপান সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ। দুবাই রোড অ্যান্ড টান্সপোর্টের আইন অনুযায়ী অমান্যকারীদের জন্য রয়েছে জরিমানার বিধান। মাত্র ৩.৬০ দিরহাম থেকে দুবাই মেট্রোর ভাড়া শুরু, সর্বোচ্চ ভাড়া ৭.৫০ দিরহাম।

যাত্রীদের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য প্রতিটি মেট্রোতে জরুরি ফ্লাশ বোতাম রয়েছে, ইন্টারকম এবং প্ল্যাটফর্মের স্ক্রিনের দরজা ইনস্টল করা আছে। ট্রেনগুলিতে জরুরি স্টপ বোতাম, ডোর রিলিজ লিভার, ইন্টারকম এবং অগ্নি নির্বাপক ফায়ার সরঞ্জামসহ সজ্জিত রয়েছে। পুরো মেট্রো ব্যাবস্থা জুড়ে চালু রয়েছে সিসিটিভি এবং পুলিশ অফিসাররা নিয়মিত স্টেশনগুলিতে দায়িত্বে থাকেন ।

প্রতিটি ট্রেন ও স্টেশনে রয়েছে ফ্রি ওয়াই-ফাই সংযোগ সুবিধা। রেসিডেন্স ও ভিজিটর যে কেউ ট্রেনে ওয়াই-ফাই সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন। আমিরাতের মোবাইল কোম্পানি উট এই বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে।

দুবাইতে পাবলিক পরিবহন হিসেবে বাস ও টেক্সি থাকলেও দুবাই মেট্রো চালু হওয়ার প্রথম সপ্তাহে দুবাই মেট্রো ব্যবহার করে ২৮ লাখের বেশি যাত্রী। দুবাই রোড অ্যান্ড টান্সপোর্ট অথরিটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত মোট ১ বিলিয়ন যাত্রী মেট্রো ব্যবহার করেছেন।

প্রতিটি স্টেশনে রয়েছে সাইকেল পার্কিং এর ব্যবস্হা। ইতিসালাত স্টেশনে ২ হাজার ৩০০ ও রাশেদিয়া স্টেশনে ২ হাজার ৭০০ গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে ট্রেন যাত্রীদের জন্যে। এছাড়া নাখিল হারবার টাওয়ার স্টেশন ৩ হাজার গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

আজ দশ বছরে পূর্ণ করবে দুবাই মেট্রো। এ ১০ বছরে ১.৫ বিলিয়ন যাত্রী দুবাই মেট্রো সেবা গ্রহণ করেছে। শুধুমাত্র ২০১৯ সালের প্রথমার্ধে ১৮.১ মিলিয়ন যাত্রী দুবাই মেট্রো ব্যবহার করেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে হিসেবে দুবাই মেট্রো আমিরাতের সবার শীর্ষ পছন্দ। এটি এমন একটি বৃহৎ প্রকল্প যা দৈনিক কয়েক হাজার মানুষের চলাচল সহজতর করে। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে মেট্রো প্রথম চালু হওয়ার পর দুবাইয়ের বাসিন্দাদের কাছে চালকবিহীন ট্রেনে চলা প্রথমে ভীতিকর মনে হলেও দুর্দান্ত গতিতে ধেয়ে চলা মেট্রো এখন সবার চলাচলের অন্যতম মাধ্যম।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button