জাকারিয়া সিটির (এক্সেলসিয়র সিলেট) বিনিয়োগকারীদের সংবাদ সম্মেলন
প্রতারিত হওয়ার পর এবার মিথ্যা মামলার শিকার প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা
অর্থ আত্মসাতের পর মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির অভিযোগ
এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেড কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে প্রতারিত হওয়ার পর এখন মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হচ্ছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা। আজ ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেডের নিয়ন্ত্রণকারী সাইদ চৌধুরী (সাবেক এমডি) এবং শাহ জামাল নুরুল হুদা (সাবেক চেয়ারম্যান) সহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় এবং পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা। এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেড সিলেটের স্বনামধন্য জাকারিয়া সিটির মালিক। সাইদ চৌধুরী ও শাহ জামাল বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেয়ার চাপ এড়ানোর কৌশল হিসেবে দায়িত্ব থেকে সরে দাড়ালেও প্রকৃতপক্ষে তারাই কোম্পানি পরিচালনা করছেন।
লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা বলেন, ২০১৪ সাল থেকে নানা চেষ্টা ও সমঝোতার মাধ্যমে তারা নিজেদের অর্থ ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কমিউনিটির গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মধ্যস্ততায় কয়েকদফা লিখিত অঙ্গীকার করার পরও সাইদ চৌধুরী তাদের অর্থ ফেরত দেননি। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল লন্ডনের হাইকোর্টে সাইদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনে মামলা করেন বিনিয়োগকারী আব্দুল বারী।
এই মামলার পরপরই সাইদ চৌধুরীর সহযোগী শাহ জামাল নুরুল হুদা বিনিয়োগকারী সিরাজ হক, আব্দুল বারী, কয়সর খান, আনিস রহমান ও মাসুক রহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে মিথ্যা মামলা দায়ের করেন। ২০১৮ সালের ২১ জুন সিলেট জালালাবাদ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর ৯০১) করে এসব প্রবাসীর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে বলা হয় যে, তাঁরা লোক পাঠিয়ে শাহ জামালের বাড়িতে হামলা করিয়েছেন এবং ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন। এর চারদিন পর ২৫ জুন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুানালে ৫৭(২) ধারায় ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে আরও একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করেন শাহ জামাল। এ মামলায়ও ভিত্তিহীন অভিযোগ করা হয় যে, এসব প্রবাসী অনলাইনে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শাহ জামালের নামে মিথ্যা ও কুরুচিপূর্ণ অপপ্রচার চালিয়েছেন। দুটি মামলাতেই সাক্ষী হিসেবে আছেন সাইদ চৌধুরী ও তাঁর সহযোগী এক্সেলসিয়র সিলেটের বর্তমান এমডি আহমদ আলী। তাঁরা বলেন, মামলাকারী শাহ জামাল নুরুল হুদা এবং তাঁর স্ত্রী ভিসাফ্রড এবং হিউম্যান ট্রাফিকিংয়ের অপরাধে ২০১২ সালে যুক্তরাজ্যের আদালতে দণ্ডিত হন। এই দণ্ডিত আসামী তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক।
ভুক্তভোগীরা বলেন, অর্থ ফেরত পাওয়ার জন্য তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। প্রতারিত হওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মিথ্যা কিছু কখনো প্রচার করেননি। যদি তাদের কোনো প্রচার- প্রকাশের কারণে বাদী শাহ জামাল সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তবে সেটি বাংলাদেশের আইনে বিবেচনাধীন হওয়ার কথা নয়। কেননা মামলার বাদী-বিবাদী এবং প্রচার-প্রকাশনা সবকিছুই যুক্তরাজ্যে হয়েছে। অন্যায় ও অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হয়রানির উদ্দেশে এসব মিথ্যা মামলা করা হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। তাই স্বাভাবিক কারণে এসব মামলার ন্যায়বিচার নিয়েও তাঁরা সন্দিহান। মামলার হয়রানির ভয়ে বিনিয়োগকারীরা যাতে অর্থের দাবি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন এবং অন্যান্য সাধারণ বিনিয়োগকারীও যাতে অর্থের হিসাব চাইতে সাহস না পায় সেজন্য এসব মামলা করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তাঁরা।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, জন্মভূমি বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়বে, নিজেদের এলাকা সিলেটের উন্নয়ন হবে, প্রজেক্টটি সফল হবে- এমন প্রত্যাশা নিয়েই তাঁরা সাইদ চৌধুরী ও শাহ জামালের কথায় বিশ্বাস করে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাদের পাঁচজনের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টাকা বলে জানান।
এসব বিনিয়োগকারী বলেন, তাঁরা প্রত্যেকে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং কমিউনিটিতে ভালভাবেই পরিচিত। বাংলাদেশে অন্যান্য ব্যবসায়ও তাদের বিনিয়োগ এবং সহযোগিতা রয়েছে বলে জানান। তাঁরা বলেন, সাইদ চৌধুরী ও এক্সেলসিয়র সিলেট লিমিটেডের এ প্রতারণামূলক কাণ্ড বাংলাদেশের বিনিয়োগের পরিস্থিতি নিয়ে প্রবাসীদের মনে আস্থার সংকট তৈরি করবে। বাংলাদেশে প্রবাসী বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত রাখতে এই প্রতারণা কাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত। তাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে সাইদ চৌধুরী, শাহ জামাল, এক্সেলসিয়র সিলেট ও জাকারিয়া সিটির বর্তমান এমডি আহমদ আলীর বিষয়ে তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোরালো আহবান জানান তাঁরা।
কমিউনিটি নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষন করে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সাইদ চৌধুরী এবং শাহ জামাল আবারও যুক্তরাজ্যে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তারা যেন আর কারো কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিতে না পারেন সে বিষয়ে সকলকে সজাগ থাকার আহবান জানানো হয়। ভুক্তভোগীরা বলেন, সাইদ চৌধুরী সুযোগ পেলেই গণ্যমান্য লোকজনের সঙ্গে ছবি তুলে ফেলেন। পরবর্তীতে সেই ছবি ব্যবহার করে নিজেকে বিক্রি করেন। তাই কমিউনিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিত- সাইদ চৌধুরী গংদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া থেকে বিরত থাকা। সামাজিকভাবে বয়কট করা। অন্যথায় এই চক্র সাধারণ মানুষকে আবারও ফাঁদে ফেলতে পারে।
সাইদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে যুক্তরাজ্যের হাইকোর্টে দায়ের করা মামলার বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই মামলা চলার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সাইদ চৌধুরী একটি আবেদন করেছিলেন। আদালত তার সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। একইসঙ্গে ওই আবেদন মোকাবেলায় আব্দুল বারীর খরচ হওয়া সম্পূর্ণ অর্থ পরিশোধ করতে সাইদ চৌধুরীর প্রতি আদেশ জারি করে আদালত। কিন্তু কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করা সাইদ চৌধুরী নিজেকে বেশ অসহায় ও দরিদ্র দাবি করেন এবং ওই খরচ পরিশোধে অপারগতা জানান। মাসে মাত্র ১৪০ পাউন্ড দেয়ার অনুমতি চেয়ে আবারও আদালতে আবেদন করেন। সাইদ চৌধুরী দাবি করেন, স্ত্রীর সঙ্গে যৌথ মালিকানায় তার যে ঘর রয়েছে, সেটি তাঁর স্ত্রীর। ঘরে তাঁর অংশ মাত্র ১ শতাংশ। আদালত তার ১৪০ পাউন্ড করে দেয়ার আবেদনও গ্রহণ করেনি। দুটি আবেদনে হেরে আব্দুল বারীর মামলার খরচ বাবদ সাইদ চৌধুরীর মোট দেনা গিয়ে দাড়ায় প্রায় ১৪ হাজার পাউন্ড। ফলে আইনীভাবে সাইদ চৌধুরীর ওই ঘরের ওপর চার্জ এনেছেন আব্দুল বারী। মূল মামলাটি এখনও শুনানীর অপেক্ষায়।
লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, সাইদ চৌধুরী বিনিয়োগের নামে প্রবাসীদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে কিভাবে আত্মসাত করেছেন, তা ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেছিলেন এসব বিনিয়োগকারীরা। একই বছরের ২৫ জুন লন্ডনে এক্সেলসিয়র সিলেটের বোর্ড অব ডাইরেক্টরদের এক সভায় সাইদ চৌধুরী ও তার সহযোগিদের বিরুদ্ধে নানা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ওই সভায় ডাইরেক্টররা কোম্পানির মুলধনের ৯ কোটি টাকার হদিস মিলছে না বলে অভিযোগ করেন। সভায় স্বতন্ত্র অডিটের মাধ্যমে প্রকৃত হিসাব উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হতে দেননি সাইদ চৌধুরী ও শাহ জামাল।
সংবাদ সম্মেলনে কোম্পানির ডাইরেক্টর আনিস রহমান ও মাসুক রহমান জানান, ২০১৪ সালে কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই তারা আয়-ব্যায়ের কোনো হিসাব পাননি। গত ৬ বছরে অন্তত ১৯ কোটি টাকা টার্নওভার হয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা। কিন্তু কোনো লাভের মুখ দেখেননি তাঁরা।
সংবাদ সম্মেলনে মামলা নথি উপস্থাপন করে বলা হয় যে, আরও অন্তত পাঁচজন বিনিযোগকারী চেক ডিসঅনারের অভিযোগে সাইদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের আদালতে তুলেছেন। এর মধ্যে একটি মামলায় সাজা এড়াতে সাইদ চৌধুরী ব্যরিস্টার মোস্তাকিম চৌধুরীকে ৪০ লাখ টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন।
সংবাদ সম্মেলনে পঠিত বক্তব্যের হুবহু কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।