উত্তর-পূর্ব সিলেট এখন পর্যটকদের তীর্থস্থান

গোলাম সরওয়ার বেলাল, জৈন্তাপুর: আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমানো ওই পাহাড়-ই কিন্তু এসবের নাটের গুরু। নিজ থেকেই সে বিছিয়েছে সবুজ-শ্যামল বিস্তর প্রান্তরকে, সাজিয়েছে আপন হাতে। নিজ হাতে বিছানো সে আদিগন্ত প্রান্তরে কেবল প্রকৃতির সন্তানেরা জীবন ধারণ করে না, দু’চোখ ভরে নয়নও জুড়ায়। নিজে রূপসী বলেই সে জানে সুন্দরের কদর। তাই তার সাজানো-বিছানো সংসারে আছে নদী-নালা-খাল-বিল-হাওর-বাঁওর, খনিজ সম্পদ আর অরণ্যের সমাহার। মনোলোভা নিসর্গ , বিচিত্র সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এ যেন এক তীর্থস্থান। আর এ তীর্থস্থান দেখতে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটক এ অঞ্চল ভ্রমণ করেন।

খাসি-জৈন্তিয়া-গারো পাহাড় আর সংলগ্ন এলাকার নিসর্গের সৌন্দর্যের কথাই যে বলা হচ্ছে, তা পাঠক হয়তো ইতিমধ্যেই বুঝে গেছেন। সিলেটের জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট কানাইঘাট আর কোম্পানীগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা কে না জানে! লালাখাল, লাল শাপলা, জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জ আর রাতারগুলের অপরূপ সৌন্দর্যের বিবরণ মানুষের মুখে মুখে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিদেশেও। তাই বিদেশীরা এখন আসছেন এসব জায়গা দেখতে। মুগ্ধ হচ্ছেন, নিজের ব্যস্ত জীবনে একটুখানি শান্তির পরশ নিচ্ছেন।

জল আর বনের ব্যতিক্রম মিতালীর দেখা মেলে রাতারগুলে। এরকম আরও কয়েকটি জলারবন আছে উত্তর-পূর্ব সিলেটের এ অঞ্চলে। এতে ঋতুকেন্দ্রীক পর্যটনের যে রেওয়াজ ছিল, তার অবসান হয়েছে। এখন বর্ষাকালে এসব পর্যটনকেন্দ্রে পর্যটকদের আনাগুনায় মেতে থাকে। শীতকালে জাফলং, লালাখাল, লোভাছড়া, ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর আর বিছনাকান্দিতে পর্যটকদের ঢল নামে। এসব জায়গায় অবশ্য বর্ষাকালেও পর্যটকদের আনাগোণা কমেনা। তাই সারা বছরই পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত থাকে এসব অঞ্চল। শীতকালে জমে উঠে ’লাল শাপলার বিল’।

অপরদিকে এসব অঞ্চলে বাঙালিদের পাশাপাশি বসবাস করে অনেকগুলো ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার লোকজন। তাদের বিচিত্র জীবনধারা আর সাংস্কৃতিক উপাদান পর্যটকদের আনন্দকে বাড়িয়ে তুলে বহুগুণ। এসব এলাকায় রয়েছে অনেকগুলো চা বাগান যেগুলোর অনুপম সৌন্দর্য উপভোগ করেন প্রাণজুড়ে। পুরো এ অঞ্চলটি প্রাগৈতিহাসিক কাল ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত জৈন্তিয়া রাজ্যের অন্তভূর্ক্ত ছিল। সে রাজ্যের রাজ-রাজাদের স্থাপনাগুলো এখনো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরো এলাকাগুলোতে। প্রাগৈতিহাসিক কালের মেগালিথিক সংস্কৃতির অনুপম নিদর্শন ছড়িয়ে আছে এখানে। এছাড়া আছে জৈন্তেশ্বরী বাড়ি, রাজবাড়ী, ঢুপি মঠ ও পান্তশালা, রাজা বিজয় সিংহের সমাধিসৌধ, ঘন্টি টাওয়ার ইত্যাদি। পর্যটকরা তাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি নিজের জ্ঞানভান্ডারকেও সমৃদ্ধ করতে পারেন এখানে।

স্বচ্ছ পানিতে নীল আকাশের রং, দু’পাশে পাথুরে টিলা আর সবুজ বন, অনতিদূরে ভারতের মেঘমাখা আকাশছোঁয়া পাহাড়। পাহাড় আর টিলার ঢালুতে বিস্তৃত চা গাছের মায়াবী বাগান যেন নিসর্গকে করেছে আরো বেশি ব্যঞ্জনাময়। এপার-ওপার দিয়ে বিনে সুতে মালা গাঁথছে ছোট্ট নৌকাগুলো। লোকজন আসে, প্রাণ ভরে দেখে আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলে পুনরায় দেখার আকুতি নিয়ে চলে যায় আপন গন্তব্যে। প্রকৃতির তারিফ করা তাদের গল্প আর ছবিগুলো কেবলই ডানা মেলে, অনুপ্রাণিত করে দেশ-বিদেশের মানুষদের। প্রলুদ্ধ হয়ে আরও বেশি দর্শক আসে, এভাবে মানুষের আনাগোণা কেবলই বাড়তে থাকে রূপের রাণী পৌরাণিক প্রমিলা রাজ্যের এ অঞ্চলে।

পাহাড়-টিলা, বনভূমি, চা বাগান, বিস্তির্ণ সমতলভূমি একই সাথে রয়েছে অনেকগুলো হাওর-বাওড় ও বিল। পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণার অপূর্ব কলধ্বনিও শুনতে পারা যায় উত্তর-পূর্ব সিলেটের এ অংশে। অর্থাৎ একজন পর্যটক বা দর্শনার্থী একদিনের এক ভ্রমণে পাহাড়-টিলা-নদী-ঝর্ণা-হাওর-বিল-সমতল ভূমির স্বাধ নিতে পারেন এখানে সহজেই তাই । তাই দাবি উঠেছে, এ অঞ্চলে পর্যটনের জন্য ’এক্রক্লুসিভ টুরিস্ট এরিয়া’ ঘোষণা করার। এছাড়া খাসিয়া জৈন্তা পাহাড় ও সিলেটের উত্তরাঞ্চলে অবিস্থত মহাভারতের যুগে “নারী রাজ্য” বা নারী দেশ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাজবংশ জৈন্তা রাজ্য শাসন করে ১৫০০ সাল থেকে খাসিয়া রাজবংশ জৈন্তা রাজ্য শাসন করে। ১৮৩৫ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক এর সময় জৈন্তা রাজ্য বৃটিশ শাসনের অধিভুক্ত হয়। এই সময়ের মধ্যে জৈন্তা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে চড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে প্রত্তত্ত্বান্ত্রিক প্রাচীন নিদর্শন যা এখনও দেশ বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। ২০১৫সালে পর্যটকদের জন্য আরেকটি স্থান উপহার দেয় স্থানীয় গন মাধ্যম কর্মীরা। প্রাকৃতিকভাবে ফুটে ওঠে উপজেলার সীমান্তঘেষা ডিবির হাওর ইয়ামবিল ও কেন্দ্রি বিলের মধ্যে লাল শাপলার এক অপরুপ সুন্দর্য। কাক ডাকা শীতের সকালে সূর্যদয়ের সাথে সাথে লাল শাপলা গুলো এক সাথে ফুটে ওঠেএমনই কুয়াশার চাদরে ডাকা ভোরে পর্যটকরাও ভিড় করে শাপলা বিলের সুন্দর্য অবলোকন করতে। পূর্ব আকাশে সূর্য যখন পশ্চিম দিকে একটু হেলে পড়ে ফুল গুলো দর্শনার্থীদের কাছ থেকে বিদায় নিতে শুরু করে। লাল শাপলা গুলো সংরক্ষণ ও রক্ষনাবেক্ষনের জন্য উপজেলা প্রশাসন বিলগুলো লিজ দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। বাংলাদেশের একমাত্র মিঠা পানির জলারবন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেষ্ট যা সিলেটের সুন্দরবন নামে খ্যাত এ স্থানটি গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত রাতারগুলে প্রাকৃতিক সুন্দর্যের এক অপার বিস্ময় জলারবনের গাছগুলো বেশিরভাগই জলে ডুবে থাকে বর্ষাকালে রাতারগুলে নৌকাই প্রধান বাহক, নৌকা নিয়ে জলে মধ্যে প্রবেশ করলেই দাড়িয়ে থাকা সারী সারী হিজল করচ গাছ পর্যটকদের মুগ্ধ করেছে প্রতিনিয়ত। তামাবিল ইমিগ্রেশন যেন আরেকটি পর্যটকদের মিলনমেলা, এখানে প্রতিদিন জাফলং বেড়াতে আসা পর্যটকরা কিছু সময়ের জন্য হলেও দুই দেশের ইমিগ্রেশন দিয়ে আসা যাওয়া পর্যটকদের সাথে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য থাকে। এই ইমিগ্রেশন দিয়ে প্রতিদিনই ভারত থেকে বাংলাদেশে পর্যটকরা ছুটে আসে আবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সেভ দ্য হেরিটেজ এন্ড এনভায়রনমেন্টের প্রধান সমন্বয়কারী আব্দুল হাই আল-হাদী বলেন, খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এ অঞ্চলটিকে পর্যটনের জন্য বিশেষ এলাকা ঘোষণা প্রয়োজন। এক ট্রিপে কম সময়ে বিচিত্র সব কিছু দেখার সুযোগ আছে। এতে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

এ বিষয়ে জৈন্তাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌরীন করিম প্রতিবেদককে বলেন জৈন্তাপুর উপজেলার লালাখাল, শাপলাবিল, জৈন্তা রাজ্যের বিভিন্ন নিদর্শন, উতলার পাড়, ইয়াংরাজার টিলা সহ উপজেলা জুড়ে প্রতিটি এলাকায়ই দর্শনীয় স্থান মনে হয়। এগুলো রক্ষনাবেক্ষণ ও দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি করতে উপজেলা প্রশাসন বিভিন্ন সময় স্থানগুলো পরিদর্শন করে আসছে। ইতি মধ্যে শাপলা বিলের লিজ বাতিল করা হয়েছে এবং দর্শনার্থীদের বসার জন্য বিলের মধ্যখানে চেয়ারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারীঘাট মঠ টিলার উপর একটি ওয়াচ টাওয়ার নির্মানের পরিকল্পনায় রয়েছে।

গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফারুক আহমদ জানান পর্যটন এরিয়াগুলোকে ডেপোলাপমেন্ট করে পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদ যৌতভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইতি মধ্যে রাতারগুল সোয়াম ফরেষ্ট পর্যটন জোনে দর্শনার্থীদের জন্য একটি উচু ওয়াচ টাওয়ার র্নিমান করা হয়েছে এবং জাফলং ও বিছনাকান্দিতে পর্যটকদের সুবিধার জন্য ওয়াচ টাওয়ার ও গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা করে দিতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যহত রয়েছে। পর্যটকদের নিশ্চিন্তে নিরাপদে ভ্রমনের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমন্বয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কম্পানিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামীম আহমদ জানান, ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর দেখতে প্রতিদিন দেশে বিভিন্ন স্থানে থেকে পর্যটকরা ছুটে আসে। তাদেরকে নৌকা করে সাদা পাথর এলাকায় নিয়ে যেতে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নৌকাগুলো নির্দিষ্ট ভাড়া নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। যাতে এখানে বেড়াতে এসে নৌকা ভাড়া নিয়ে হয়রানি শিকার না হয়। প্রতিটি নৌকায় লাইফ জ্যাকেট প্রধান করা হয়েছে এবং গাড়ি পার্কিং এর জন্য একটি জায়গা নির্ধারন করে দেওয়া হয়। এখানে পর্যটকদের সার্বিক সহযোগিতা করতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে।

জৈন্তাপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল আহমদ বলেন শাপলা বিলের লাল শাপলাগুলো বাংলাদেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত। আমরা ফুলগুলো দর্শনার্থীদের মনের মধ্যে বিলিয়ে দিতে ইতি মধ্যে মহাসড়কের সাথে লাল শাপলার বিলে যোগাযোগ স্থাপন করতে পরিষদের পক্ষ থেকে রাস্তা সংস্কার কাজ করে দেয়া হয়েছে এবং বিলের মধ্যে শাপলার গাছগুলো যাতে নষ্ট না হয় এর জন্য বিলে মাছ আহরণ ও মহিষ চরানো থেকে বিগত থাকতে স্থানীয়দের সাথে আলোচনা করে বন্ধ করা হয়েছে এবং জৈন্তা-জাফলং বেড়াতে আসা পর্যটকরা যাতে নিরাপদে যাতয়াত করতে পারে এর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরবদা সতর্ক অবস্থায় থাকতে বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button