ভারতজুড়ে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার আতঙ্কে মুসলমানরা

বছরতিনেকের শিশুকন্যাকে নিয়ে একটানা ১২ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সাবিনা বিবি। এই সময়টায় তাদের পেটে এক ফোঁটা পানি কিংবা খাবার পড়েনি। রেশন কার্ডে নিজের ভুল বানান ঠিক করতেই তাদের এতটা অপেক্ষা। পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বাসুদেবপুরের সরকারি উন্নয়ন কার্যালয়ের বাইরে আরো শত শত নারী-পুরুষ দাঁড়ানো। তাদের মধ্যে ৩৩ বছর বয়সী সাবিনা বিবিও একজন।

বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া পূর্ব ভারতীয় রাজ্যটিতে মুসলমানরা এখন মারাত্মক স্নায়ুবিক চাপে রয়েছেন। দেশটির এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাজ্যটিতে জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ মুসলমানরা। গেল মাসে জাতীয় নাগরিকত্ব নিবন্ধন কার্যক্রম সারা দেশে কার্যকর করার হুমকি দিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ১৯ লাখ লোককে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও তাদের অর্ধেকের বেশি হিন্দু বলে ধারণা করা হচ্ছে। নাগরিকত্বের সঠিক প্রমাণ দিতে না পারলে এসব লোকের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।-খবর আরব নিউজের

দেশের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ পরিবর্তনের মাধ্যমে হিন্দু ও অন্য অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি।

রাষ্ট্রহীন হিন্দুদের ভারতের নাগরিকত্ব দিতে পার্লামেন্টের আগামী অধিবেশনে একটি নাগরিকত্ব সংশোধন বিল উঠানোর পরিকল্পনা করেছে বিজেপি। কিন্তু দেশটিতে বসবাস করা কয়েক কোটি মুসলমানের জন্য এমন কোনো আশ্বাস নেই। আর এই আতঙ্ক স্বাভাবিকভাবেই এখন সবচেয়ে বেশি পশ্চিমবঙ্গে। বিধানসভার আগামী নির্বাচনে রাজ্যটি কব্জায় নেয়ার পরিকল্পনা বিজেপির। মুসলমানদের আশঙ্কা, রাজ্যটিতে জাতীয় নাগরিকত্ব তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মুসলমানকে রাষ্ট্রহীন ঘোষণা করতে পারে ক্ষমতাসীন মোদি সরকার।

সাবিনা বিবি বলেন, বিজেপি এযাবৎকাল বলে আসছে, তারা পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিকত্ব নিবন্ধন কার্যকর করতে যাচ্ছে। এ রাজ্যের মুসলমানরা এতে বেশ ভয়ের ভেতর রয়েছেন। তারা কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখতে চাচ্ছেন না।

‘কেরালায় আমার স্বামী অবকাঠামো শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি জানিয়েছেন, রেশন কার্ডে থাকা আমাদের নাম সংশোধন করা উচিত। এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। আমার স্বামী ও আমার নামের বানান সংশোধন করতেই আমাকে এখানে দাঁড়াতে হয়েছে,’ জানালেন এই ভারতীয় মুসলমান নারী।

একুশ বছর বয়সী সায়রা বানুও গত ১০ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে। তার ৬৫ বছর বয়সী বাবার নাম সংশোধন করতেই হবে তাকে। সরকারি একটি নথিতে নামের ভুল বানান ঠিক করে দেয়া এখন তাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করছেন।

সায়রার ভাষ্য, এটা কোনো স্বাভাবিক সময় না। সরকারি নথিতে সামান্য ভুল বানানও আমরা তুচ্ছ করে এড়িয়ে যেতে পারি না। কারণ এর মধ্যে আমাদের পরিচয়ের প্রশ্ন রয়েছে। নয়াদিল্লিতে আমাদের একটা সরকার আছে, যারা ভারতকে হিন্দু ও মুসলমানের দৃষ্টিতে দেখে আসছে। মুসলমানদের আলাদা চোখে দেখা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগানা জেলা থেকে জাতীয় নাগরিকত্ব নিবন্ধনের হুমকিতে আত্মহত্যার খবরও এসেছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবদুল মতিন বলেন, এনআরসি সংশ্লিষ্ট ঘটনায় গত মাসে অন্তত ১৬ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন।

অধ্যাপক আবদুল মতিন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, সেখানে তিন ব্যক্তি মারা গেছেন। সরকারি অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হিটস্ট্রোকে তারা মারা গেছেন। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েও তিন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। নাগরিকত্বের নথি দিতে না পারায় রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়ার দুশ্চিন্তায় তাদের এই মৃত্যু।

মুরশিদাবাদ জেলাভিত্তিক সাংবাদিক সুব্রত চক্রবর্তী বলেন, পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ লোকজনের জীবন অচল হয়ে পড়েছে। তারা এখন নাগরিকত্বের কাগজপত্র শনাক্ত ও সেগুলোকে কার্যকর করা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

তিনি বলেন, এ অঞ্চলে কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। গ্রামীণ এলাকার দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। এটা অবশ্যই একটি নজিরবিহীন পরিস্থিতি।

‘মঙ্গলবার অমিত শাহের বক্তব্যের পর স্থানীয় মুসলমানদের হতাশা আরও বেড়েছে। কলকাতায় হিন্দুদের নিশ্চয়তা দিয়ে তিনি বলেন, সরকার তাদের প্রতি খেয়াল রাখবে,’ আরও জানালেন এই সাংবাদিক।

পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির মুখপাত্র সায়ন্ত বসু বলেন, বিজেপি কেবল এই রাজ্যেই এনআরসি আনতে যাচ্ছে না, পুরো ভারতজুড়ে। কিন্তু পার্লামেন্টে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল পাস হওয়ার পরই পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি প্রণয়ন করা হবে।

এই বিজেপি নেতার ভাষ্য, আইন সংশোধনের মাধ্যমে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা নিপীড়িত হিন্দু সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা দিতে চাই।

তার মতে, ভারতের সত্যিকার নাগরিক মুসলমানদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। অবৈধ অভিবাসীদের কোনো দেশই আশ্রয় দেবে না। যদি আপনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে প্রবেশ করেন, তাহলে তারা কি আপনাকে নাগরিকত্ব দেবে?

তবে অধ্যাপক আবদুল মতিন বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান প্রধান জেলাগুলোতে আতঙ্কের একটা অনুভূতি রয়েছে। নাগকিত্ব নিবন্ধন বিলে মুসলমানদের অংশীভূত না করতে অমিত শাহের প্রকাশ্য ঘোষণার পর এই ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।

এই অধ্যাপকের মতে, মুসলমানরা কোথা থেকে উত্তরাধিকার সনদ পাবেন, তা নিয়েই তাদের মূল উদ্বেগ। এ ধরনের নথিপত্র সংরক্ষণের ব্যাপারে লোকজন খুব মনোযোগী থাকেন না। কাজেই তাদেরও ভয় যে, আসামের লোকজনকে যেভাবে তাদের পূর্বপুরুষের নথি দাখিল করতে হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গেও তেমনটা করতে হতে পারে।

এই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ বলেন, বিজেপির লোকজন অহরহ সংহিস বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন। এতে সংখ্যালঘুদের ভীতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তারা। বিজেপির ভারতে মুসলমানরা অনাহূত বোধ করছেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button