কী হতে যাচ্ছে বাবরী মসজিদের ভাগ্যে?
সৈয়দ মাসুদ মোস্তফা: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ভারতের অযোধ্যার ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ সংক্রান্ত মামলার শুনানি শেষ হয়েছে সম্প্রতি। ১৬ অক্টোবর এ মামলার প্রাত্যহিক শুনানি শেষ হবে বলে আগেই জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। বাস্তবেও তাই হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে আগামী ১৭ নভেম্বর উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে চাঞ্চল্যকর ও স্পর্শকাতর এই মামলার রায় ঘোষণা হবে। তবে সম্ভাব্য রায়ে এই সমস্যার সমাধান হবে, না নতুন সঙ্কটের সৃষ্টি করবে-তা নিয়ে বিশে^র শান্তিকামী মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। আর এর শেষ দেখার জন্য বিশ^বাসীকে অধীর আগ্রহে উপেক্ষায় করতে হবে।
গত ১৬ অক্টোবর ভূমি নিয়ে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করা প্যানেলের দ্বিতীয় দফা মধ্যস্থতা সংক্রান্ত রিপোর্ট আদালতে জমা দেয়ার কথা ছিল। এর আগের দিন শুনানিতে দু’পক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে তীব্র বাদানুবাদও হয়েছিল। সেই শুনানি শেষেই ১৬ অক্টোবর ‘শুনানি শেষ’ করার কথা বলেছিলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি। সপ্তাহব্যাপী ‘দশেরা’ উৎসবের ছুটি শেষে চলতি সপ্তাহের ১৪ অক্টোবর থেকে সংবেদনশীল এ মামলার শেষ পর্বের শুনানি শুরু হয়। বিবাদমান পক্ষগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় চলতি বছরের ৬ আগস্ট থেকে ভারতের প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক আদালতে এ মামলাটির শুনানি শুরু হয়। কয়েক দশক ধরে চলা এ ভূমি বিরোধ মেটাতে বেশ কয়েকবার মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। মূলত উগ্রবাদী হিন্দুদের একগুয়েমীর কারণেই এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। কারণ, তাদের লক্ষ্য শান্তি নয় বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্টই তাদের আসল উদ্দেশ্য। শুনানীকালে ভেঙে ফেলা বাবরী মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের দাবি জানানো পক্ষের আইনজীবী আদালতে বলেন, ‘মুসলমানরা অন্য যেকোনো মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করতে পারেন। শুধু অযোধ্যাতেই ৫৫ থেকে ৬০টি মসজিদ রয়েছে। কিন্তু হিন্দুদের কাছে এটি রামের জন্মস্থান। আমরা জন্মস্থান পরিবর্তন করতে পারি না’। পক্ষান্তরে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরা বলছেন, ‘১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বাবরী মসজিদের জমি নিয়ে হিন্দুদের পক্ষ থেকে কোনো দাবি তোলা হয়নি। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদটি ভেঙে দেয়। তাই এখন সেখানে মসজিদটি পুনঃস্থাপনই যৌক্তিক’।
এদিকে এই মামলা নিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে; এমন আশঙ্কায় উত্তরপ্রদেশ সরকার আগে থেকেই অযোধ্যায় চার বা ততোধিক লোকের যে কোনো জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। জমি সমস্যা নিয়ে মধ্যস্থতা কমিটি কোনো সমাধান খুঁজে বের করতে সক্ষম না হওয়ায় গত ৬ আগস্ট থেকে ভারতের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারকের বেঞ্চ এই মামলার দৈনিক শুনানি শুরু করে। ২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টের চারটি দেওয়ানি মামলার রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে ১৪টি আবেদন জমা পড়ে। এলাহাবাদ আদালত রায়ে বলা হয়, অযোধ্যার ২ দশমিক ৭৭ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, নির্মোহী আখড়া এবং রামল্লা-এই তিনটি দলের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া উচিত। কিন্তু এই রায় বিবাদমান কোন পক্ষের কাছেই মনোপুত হয়নি। ফলে উভয় পক্ষই উচ্চ আদালতে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল দায়ের করে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও সে আপিলের নিষ্পত্তি হয়নি।
উগ্রবাদী হিন্দুদের দাবি এই স্থানটি রামের জন্মস্থান। সেখানে একটি প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের ওপর বাবরী মসজিদ নির্মিত হয়েছিল বলে তারা দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে। কিন্তু তাদের এ দাবির পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করতে পারেনি। ষোড়শ শতকে নির্মিত মসজিদটি ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভেঙে দেয় ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীরা। এই ঘটনার জেরে শুরু হয় ব্যাপক মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা। নিহত হয় প্রায় দুই হাজার মানুষ। গত ১৬ অক্টোবর নির্ধারিত সময়ের আগেই এই গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানি শেষ হয়। ৩৯ দিন টানা শুনানির শেষে ৪০ দিনের মাথায় এ দিন শুনানি শেষের নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি। তবে রায় হতে পারে কমপক্ষে ২৩ দিন পর। আগামী ১৭ নভেম্বর অবসর নিচ্ছেন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। রায় ঘোষণা হতে পারে তার আগেই।
শুনানীর সমাপ্তি ও রায় ঘোষণার দিনক্ষণ এগিয়ে আসলেও এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে উগ্রবাদী তৎপরতা থেমে নেই। সে ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরী মসজিদের স্থানে আবারও সরব হয়ে উঠেছেন যোগগুরু রামদেব। সম্প্রতি তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, অযোধ্যায় মন্দির না হলে কোথায় তা তৈরি হবে? রামদেব বলেন, ‘আমি খুব দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে রাম মন্দির অযোধ্যাতেই তৈরি হবে। অযোধ্যায় না হলে কোথায় হবে? রাম মন্দির অবশ্যই মক্কা-মদিনা বা ভ্যাটিকান সিটিতে নির্মাণ হবে না।’ যোগগুরু আরও বলেন, ‘ভগবান শ্রী রামচন্দ্র শুধু হিন্দুদের নয়, মুসলমানদেরও পূর্বপুরুষ ছিলেন। রাম মন্দির নির্মাণ ভোট ব্যাংকের রাজনীতি নয়, এই মন্দির জাতীয় গর্ব’। তিনি এর আগে বলেছিলেন যে, ‘রাম মন্দির নিয়ে শিগগিরই আইন নিয়ে আসা হোক, মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। যদি আইন না নিয়ে আসা হয় তবে লোকজন নিজেরাই মন্দির তৈরি করতে শুরু করবে এবং তা থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসার সৃষ্টি হতে পারে’।
রামদেব বলেন, ‘মানুষ ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। লোকজন নিজেরাই রাম মন্দির নির্মাণ করলে সাম্প্রদায়িক হিংসার ঘটনায় দেশ অশান্ত হবে। আমি বিশ্বাস করি এ দেশে রামের কেউ শত্রু নেই, রাম হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রিষ্টানদেরও পূর্বপুরুষ।’ রাম দেবের এমন মন্তব্যের তীব্র সমালোচনা করেছে কংগ্রেস। বিরোধী দলের দাবি, বিজেপির থেকে সুবিধা পাওয়ার জন্যই রাম দেব অযোধ্যায় মন্দির নিয়ে উদ্যোগী হয়েছেন। আর এই উগ্রবাদী অবস্থান পুরো পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
চলতি বছরের শুরুতে ভারতীতে লোকসভা নির্বাচনের আগে বাবরী মসজিদ-রামমন্দির ইস্যুতে ভারতে উগ্রবাদী মাতম শুরু হয়েছিল। মূলত নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক আনুকূল্য পাওয়ার জন্যই ক্ষমতাসীন বিজেপিই উগ্রবাদীদের উস্কে দেয়। তারা এজন্য মুসলমান, মুসলিম স্থাপনা ও মুসলিম শাসনামলে দেয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানের নাম বিশেষভাবে টার্গেট করেছিল।
মূলত ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা অতিমাত্রায় বেড়েছে। তারা আগ্রায় মোঘল সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক তাজমহল নিয়ে নানাবিধ ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই তাজমহলের অভ্যন্তরের মসজিদে নামাজ আদায় করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি এবং উগ্রবাদী দলের নেতাকর্মীরা সেখানে পুজা-অর্চনা শুরু করেছে বলে। তারা মুসলিম আমলে দেয়া বিভিন্ন স্থানের নাম পরিবর্তনের দাবি জানাচ্ছে এবং ইতোমধ্যেই কয়েকটি ঐতিহাসিক শহরের নাম পরিবর্তনের ঘটনাও ঘটেছে। উত্তর প্রাদেশের এলাহাবাদের নাম ‘প্রয়াগরাজ’ ও ফৈজাবাদের নাম ‘অযোধ্যা’ করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে মোঘল আমলের ইতিহাস।
সে ধারাবাহিকতায় তারা এবার অযোধ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের স্থানকে বিশেষভাবে টার্গেট করেছে। সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টির জন্যই অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে চলতি বছরের শুরুতে সেখানে একটি সমাবেশও করেছে। সম্প্রতি সে প্রবণতা আরও বেড়েছে। তাই ঐতিহাসিক অযোধ্যা নগরীতে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকন্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপকভাবে।
বাবরী মসজিদ ভারতের উত্তর প্রদেশের, ফৈজাবাদ জেলার অযোধ্যা শহরের রামকোট হিলের উপর অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ। ১৯৯২ সালে একটি রাজনৈতিক সমাবেশের উদ্যোক্তারা, ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুযায়ী মসজিদ ক্ষতিগ্রস্থ হবে না এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় একটি রাজনৈতিক সমাবেশ শুরু করে। যা একটি সম্মিলিত দাঙ্গার রূপ নেয় এবং ঐতিহাসিক এই মসজিদটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়। ফলস্বরূপ ওই একই সালে ভারতের প্রধান শহরগুলোতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ফলে মুম্বাই ও দিল্লী শহরে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। মসজিদটি ১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে মুঘল স¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবরের আদেশে নির্মিত এবং তাঁর নাম অনুসারে নামাঙ্কিতও করা হয়।
দিল্লীর সুলতানি এবং তার উত্তরাধিকারী মুঘল সাম্রাজ্যের শাসকরা শিল্প এবং স্থাপত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাঁদের নির্মিত অনেক সমাধি, মসজিদ ও মাদরাসা সূক্ষ্ম নির্মাণ কৌশলের নিদর্শন বহন করে। মুঘলদের স্থাপত্য তুঘলক রাজবংশের স্থাপত্যের প্রভাব বহন করে যার একটি স্বতন্ত্র গঠন শৈলী আছে। ভারতের সর্বত্র মসজিদগুলোর ভিন্ন ভিন্ন গঠনশৈলী আছে যা বিভিন্ন সময়ে নির্মিত হয়েছিল। এই নির্মাণগুলির মধ্যে আদিবাসী শিল্প ঐতিহ্য এবং স্থানীয় কারিগরদের মার্জিত শৈলী ও দক্ষতা উভয়ই প্রকাশ পায়। মসজিদের নির্মাণে আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক জলবায়ু, ভূখন্ড, উপকরণ ইত্যাদি প্রভাব ফেলতো যার ফলে বঙ্গ, কাশ্মীর ও গুজরাটের মসজিদের মধ্যে বিরাট পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বাবরী মসজিদ জানপুরের সুলতানি স্থাপত্যের পরিচয় বহন করে। বাবরী মসজিদ তার সংরক্ষিত স্থাপত্য ও স্বতন্ত্র গঠনশৈলীর জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
মূলত বাবরী মসজিদ ও কথিত রাম মন্দির বিষয়ক জটিলতা ভারতীয় উচ্চ আদালতে বিচারাধীন থাকলেও উগ্রবাদীরা আদালতের কোন তোয়াক্কা না করে রামের কথিত জন্মভূমিতে মন্দির নির্মাণের দাবিতে মাঝে মাঝেই পুরো অযোধ্যাকেই অশান্ত করে তোলে। সম্প্রতি আদালতের রায়ের দিকে না তাকিয়ে সরকারকে নির্বাহী আদেশ জারি করার দাবি জানিয়েছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। অন্যদিকে অযোধ্যাতে ক্ষমতাসীন বিজেপির শরিক ও মহারাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনা নতুন করে তৎপরতা শুরু করেছে। তারাও সম্প্রতি বিরোধপূর্ণ এলাকায় বৃহত পরিসরে সমাবেশ করে মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। ফলে অযোধ্যাসহ পুরো ভারতেই মুসলমানরা এখন সীমাহীন নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছেন এবং জানমালের নিরপত্তার জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
গত লোকসভা নির্বাচনে প্রচারাভিযান চলাকালে সাম্প্রদায়িক আনুকূল্য পাওয়ার জন্য রাম মন্দির বিতর্ককে নতুন করে উস্কে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সে জের এখন পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ক্ষমতাসীন বিজেপির ইশতেহারেও বলা হয়েছে, তারা রাম মন্দির-বাবরী মসজিদ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ই মেনে নেবে। ভারতীয় সরকার মুখে এসব কথা বলতেও নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা উগ্রবাদী কোন তৎপরতার বিরুদ্ধে কোন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি অতি উৎসাহ নিয়েই তাদের অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কথিত রাম মন্দির নির্মাণ ইস্যুতে উগ্রবাদী তৎপরতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারও ৯২’র মতো আতঙ্কের পরিবশে সৃষ্টি করেছে সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাদের বেশিরভাগই ঘরবাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। যারা নিজেরা যেতে পারেননি, তারা ছোটদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ বিষয়ে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের পক্ষে বলা হয়েছে, ‘ভিএইচপি-এর ধর্ম সংসদ নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কে ভুগছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা। সে জন্যই মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের পরিবারের ছোটদের এবং বয়স্কদের অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।’ এতে আরও বলা হয়, ‘গোটা পরিস্থিতির দিকে আমরা নজর রাখছি। কোর্টের রায়ের পাশাপাশি এখানে কী ঘটে সে দিকে নজর রাখছি আমরা। আতঙ্কে আযোধ্যা ছেড়ে অনেকে লখনৌ চলে গেছেন।’
উল্লেখ্য, ১৯৯২ সনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ষোড়শ শতাব্দীতে মুসলিম শাসনামলে নির্মিত এই মসজিদটি ভেঙ্গে ফেলে। সে সময়ে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অযোধ্যা এবং ভারতের অন্যান্য স্থানে হিন্দু-মুসলিম যে দাঙ্গা হয় তাতে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এবারও বিপদের আশঙ্কায় অনেক মুসলিম ইতিমধ্যে অযোধ্যা থেকে অন্যত্র চলে গেছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকার মুসলমানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
ভারত সরকারের নিস্ক্রিয়তা ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার কারণেই অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে আবারও সক্রিয় ও সহিংস হয়ে উঠেছে শিব সেনা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। তাদের দাবি একটি হিন্দু মন্দিরের জায়গায় মুসলিম শাসকরা এই মসজিদটি তৈরি করেছিল। তাই এখানে একটি রাম মন্দির নির্মাণ করতে হবে। দু’টি দলই পৃথক অনুষ্ঠান করবে এবং তাদের উদ্দেশ্য হলো রাম জন্মভূমি মন্দিরের সূচনা করা। যদিও উগ্র হিন্দুদের দাবি যৌক্তিক ও ইতিহাস সম্মত নয়।
যাহোক ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরী মসজিদের স্থলে রাম মন্দির নির্মাণের দাবিতে উগ্রবাদীরা সব সময়ই অনড় অবস্থানে। সম্প্রতি তারা এ বিষয়ে নিজেদের তৎপরতা বাড়িয়েছেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা একটি ‘ধর্ম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা ও সে সংসদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। আর সে উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তারা সম্প্রতি রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে এবং সে তৎপরতা এখন অব্যাহত আছে। তারা এ বিষয়ে অযোধ্যায় একটি বৃহত্তর সমাবেশও করেছে চলতি বছরের শুরুতে। গৃহীত কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে রাম জন্মভূমিতে পূজা করা এবং সরযু নদীর তীরে সস্ত্রীক আরতি করা। ফলে অযোধ্যা নগরীতে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ব্যাপক প্রাণহানীর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে রাম জন্মভূমি-বাবরী মসজিদ জমির বিবাদ নিয়ে চলা মামলা ও আদালতের রায় ঘোষণার আগেই বাবরী মসজিদের উপর রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন বিজেপি নেতা সাক্ষী মহারাজ। এমনকি মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের দিনক্ষণও স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির এই সাংসদ। সাক্ষী মহারাজ জানিয়েছেন, আগামী ৬ ডিসেম্বর থেকে ওই স্থানে রামের মন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হবে। নিজের সংসদীয় এলাকা উন্নাওতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিজেপির এই নেতা বলেন, ‘এই স্বপ্নটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই বাস্তবায়িত হয়েছে।’
সবশেষে মুঘল স¤্রাট বাবরকে ‘হানাদার’ তকমা দিয়ে কট্টরপন্থী এই গেরুয়া নেতা বলেন, ‘সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে এই সত্যটি মেনে নিতেই হবে যে, বাবর তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন না, তিনি একজন হানাদার ছিলেন। এই মন্দির নির্মাণে হিন্দু ও মুসলমানদের একসঙ্গে কাজ করা উচিৎ।’ উগ্রবাদীরা তাদের অযৌক্তিক দাবিতে অনড় থেকে নতুন করে মাতম শুরু করেছে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি আবারও বিস্ফোরোন্মুখ হয়ে উঠেছে। এমতাবস্থায় সেখানে নতুন করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ব্যাপক প্রাণহানীর আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
উল্লেখ্য, ২৭ বছর পূর্বে ভেঙে ফেলার আগে বিরোধপূর্ণ জায়গাটিতে ১৬ শতক আয়তনের বাবরী মসজিদ ছিল। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে সেটি ভেঙে দেয় উগ্রবাদী শিবসেনার হিন্দু কর্মীরা। এই ঘটনা ঘটানোর পেছনে তারা যুক্তি দেখায়, ‘অযোধ্যা ভগবান রামচন্দ্রের জন্মভূমি। মসজিদের জায়গাটিতে আগে রামের মন্দির ছিল। পরে মন্দিরের ভগ্নাবশেষের ওপর মসজিদ তৈরি করা হয়েছে।’ মসজিদ ভেঙে ফেলার ঘটনায় পুরো ভারতজুড়ে হিংসার পরিবেশ তৈরি হয় তখন। এই ঘটনা শেষ পর্যন্ত হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ও হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানী পর্যন্ত গড়িয়েছিল ।
দীর্ঘ শুনানীর পর ভারতের উচ্চ আদালত যখন বাবরী মসজিদ ইস্যুতে একটি রায় দিতে যাচ্ছে, তখন বিরোধপূর্ণ স্থানে আদালতের রায় ঘোষণার আগেই রাম মন্দির নির্মাণের উগ্রবাদী ঘোষণা আদালতকে প্রভাবিত করার অপতৎপরতা হিসেবেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই ভারতে মুঘল স¤্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের স্বপ্নের ‘বাবরী মসজিদ’এর ভাগে কী হতে যাচ্ছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সার্বিক পরিস্থিতি যে ইতিবাচক নয় তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।