প্রিয়নবী সা. এর অতুলনীয় বৈশিষ্ট্য
মুহাম্মাদ বশীরউল্লাহ: প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম। তিনি ছিলেন অসামান্য সৌন্দর্য মন্ডিত এবং পরিপূর্ণ স্বভাবের এমন এক ব্যক্তিত্ব মানব সমাজে কোনোকালেও যার কোনো প্রকার বা কোনো ধরনের তুলনা হয় না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ছিলেন, সর্বগুণে গুণান্বিত এবং সর্বপ্রকার চরিত্র ভূষণে বিভূষিত এমন এক মহান ব্যক্তি যার সংশ্রবে কোনো ব্যক্তি আসা মাত্রই শ্রদ্ধায় হৃদয় মন পরিপূর্ণ না করে পারতেন না। জাতি ধর্ম-বর্ণ এবং শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষেরই তিনি ছিলেন অকৃত্রিম বন্ধু, একান্ত নির্ভরযোগ্য সুহৃদ এবং পরম দরদী আপন জন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর সাহচর্য-প্রাপ্ত ব্যক্তিগণও তার জানমালের হিফাজত, সেবা-যত্ম এবং মান-মর্যাদা সমুন্নত রাখার ব্যপারে এতই সচেতন ও তৎপর থাকতেন যে, মানব জাতির ইতিহাসে কোনো কালেও এর কোনো নজীর নেই।
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর বন্ধু ও সাহাবায়ে কেরামগণ রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু তাকে মহব্বত করতেন আত্মহারার সীমা পর্যন্ত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর জন্য তাদের প্রাণাধিক এই ভালবাসার কারণ ছিলো, মানবত্বের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে এত অধিক পূর্ণত্বা প্রদান করা হয়েছিলো যা কোনো দিন অন্য কাউকে দেয়া হয় নি। আমার অসাহায়ত্বের স্বীকারোক্তিপূর্বক পাঠকদের খিদমতে খুবই বিনয়ের সঙ্গে উপরিউক্ত বিষয়ের সার-সংক্ষেপ তুলে ধরলাম।
বর্ণিত আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর বয়স যখন বার বছর। কারো মতে, বার বছর দুই মাস দশ দিন। (ইবনে জওয়ী, তালকিহুল ফোহুম, পৃষ্ঠা : ৭) সে সময় ব্যাবসা উপলক্ষে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম শাস দেশে (সিরিয়া) গমন করেন। এ সফরের এক পর্যায়ে তাঁরা বসরায় গিয়ে উপস্থিত হন। বসরা ছিলো শাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত একটি স্থান। হুরানের কেন্দ্রিয় শহর। সে সময় এটা আরব উপদ্বিপের রোমানদের আয়ত্বাধীন রাষ্ট্রের রাজধানী ছিলো। এ শহরে জারজিস নামক একজন খিস্ট্রান ধর্মযাজক (রাহেব) থাকতেন। তার উপাধি ছিলো বুহাইরা। এ উপাধিতেই তিনি সকলের কাছে পরিচিত ও প্রসিদ্ধ ছিলেন। মক্কার ব্যবসায়ী দল যখন বুসরায় শিবির স্থাপন করেন, তখন রাহেব গীর্জা থেকে বেরিয়ে তাদের কাছে আসেন। আতিথেয়তায় তাদেরকে আপ্যায়িত করেন। অথচ এর পূর্বে কখনো তিনি এবাবে গীর্জা থেকে বেরিয়ে কোনো বানিজ্য কাফেলার সঙ্গে সাক্ষাত করেন নি। তিনি কিশোর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর অবয়ব, আচরণ এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝতে পারেন, ইনিই হচ্ছেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দিশারী, আখেরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর হাত ধরে তিনি বললেন, ইনি হচ্ছেন বিশ্বজাহানের সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। আল্লাহ তাকে বিশ্বজাহানের রহমত রুপে রাসুল মনোনীত করবেন। আবু তালিব বললেন, আপনি কি ভাবে অবগত হলেন, তিনিই হবেন আখেরী নবী ? বুহাইরা বললেন, গিরি পথে ঐ প্রান্ত থেকে তোমাদের আগমন যখন আমার দৃষ্টি গোচর হলো, আমি দেখতে পেলাম, সেখানে এমন কোন গাছ-গাছালী কিংবা পাথরনুড়ি ছিলো না যা তাকে (প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম) কে সিজদা করে নি। এ সমস্ত জিনিস নবী রাসুল ছাড়া সৃষ্টিরাজির ক্ষেত্রে অন্য কাউকেও কখনই সিজদা করে নাই। তাছারা ‘মোহরে নবুওয়াত’ দেখেও আমি তাকে চিনতে পারি। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেল সূত্রে আমরা এসব কিছু অবগত হই।
ইবনে আসাকির, জালহামা বিন আরাফাত থেকে বর্ণনা করেন, আমি একবার মক্কায় আগমন করলাম। দুর্ভিক্ষের কারণে মানুষ তখন খুবই নাজেহাল এবং সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত ছিলেন। কুরাইশগন আবু তালিবকে বললেন, হে আবু তালিব! আরববাসীগণ দুর্বিক্ষজনিত চরম আকালের মুখোমুখি হয়েছেন। চলুন, আমরা সকলে আল্লাহ’র কাছে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করি। এ কথা শোনার পর আবু তালিব বালক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। এ বালক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কে আকাশে মেঘাচ্ছন্ন এমন এক সূর্য বলে মনে হলো যার থেকে ঘন মেঘমালা যেন এখনি আলাদা হয়ে গেল। এ বালক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর আশে পাশে আর অন্যান্য বালকও ছিলো, কিন্তু বালকের মুখমন্ডল থেকে অনুপম বৈশিষ্ট্য যেন ঠিকরিয়ে পড়ছিলো।
আবু তালিব বালক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর হাত ধরে কা’বা গৃহের কাছে নিয়ে গেলেন। কা’বার দেয়ালের সঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর পিঠ মুবারক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম চাচার আঙ্গুল ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। সে সময় আকাশে এক টুকরা মেঘও ছিলো না। অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে মেঘে আকাশ ছেয়ে গিয়ে আধাঁর ঘনিয়ে এল। শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এত বেশি হলো, উপত্যকায় প্লাবনের সৃষ্টি হয়। এর ফলে শহর ও মরু অঞ্চল পুনরায় সতেজ-সজীব হয়ে ওঠে। এ ঘটনার জন্য আবু তালিব বালক প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর প্রশংসায় যে কবিতা পাট করেছিলেন তা হলো,
‘‘সেতো সুন্দরের প্রতীক। তাঁর চেহারা মুবারক দ্বারা রহমাতের বারি কামনা করা হয়।
সে ইয়াতিমদের আশ্রয়স্থল এবং বিধবাদের অভিভাবক।’’
বর্ণিত আছে, হিজরতের সময় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম উম্মে মা’বাদ খোজারিয়া নামক এক মহিলার তাবুর পাশ দিয়ে গমন করেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর গমনের পর তার চেহারা মুবারক সম্পর্কে সেই মহিলা নিজের স্বামির কাছে যে বর্ণনা চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তা হচ্ছে- ঝকঝকে গায়ের বর্ণ, সমুজ্জ্বল মুখমন্ডল, সুশোভন দেহ-সৌষ্ঠব, লম্বোদর ও টেকো মাথা থেকে ত্রুটিমুক্ত, সুমিষ্ট উজ্জ্বলতার সুতা, সুশোভন চিত্র, দীর্ঘ পলক বিশিষ্ট সুরমা সুশোভিত নয়ন যুগল, গাম্ভীর্য-মন্ডিত কণ্ঠস্বর, দীর্গ গ্রীবা, পরস্পর সন্নিবেশিত চিকন ভ্রুযুগল, জাঁমকালো-কালো চুল, নীরবতা অবলম্বন করলে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে গাম্ভীর্য, অত্যন্ত আকষর্ণীয় কথনভঙ্গী, সুমিষ্টভাষী, সুস্পষ্ট-পরিচ্ছন্ন কথাবার্তা, না সংক্ষিপ্ত না অতিরিক্ত, কথা বললে মনে হয় মালা থেকে মুক্তা ঝরছে, মানানসই মধ্যম উচ্চতা বিশিষ্ট দেহ, না অস্বাভাবিক দীর্ঘ না খাটো, দুই শাখার মধ্যে এক শাখা বিশিষ্ট তিনটির মধ্যে যেটি সবচাইতে তাজা, সুন্দর ও উজ্জ্বলতাপূর্ণ। বন্ধুগণ তার চারপাশে গোলাকৃতি ধারণ করেন। তিনি যখন কোনো কিছু বলেন, তারা অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে শোনেন। তার পক্ষ থেকে কোনো নির্দেশপ্রাপ্ত হলে তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করেন। আনুগত্যশীল, সম্মানিত, সুমিষ্ট ও স্বল্পভাষী। (যা’দুল মা‘আদ ২য় খন্ড)
হযরত আলী রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু এর এক বর্ণনায় আছে, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর মাথা ছিলো বড়, সন্ধির (জোড়ের) হাড্ডিগুলো ছিলো ভারী ভারী এবং বক্ষপটে ছিলো পশমের দীর্ঘ রেখা। পথ চলার সময় সামনের দিকে এমন ভাবে একটু ঝুকে চলতেন যাতে মনে হত, তিনি যেন কোনো ঢালু স্থান থেকে অবতরণ করছেন। (তিরমিযি মা‘আ শরাহ)
হযরত জাবির রাদি-আল্লাহু তাআলা আনহু বর্ণনা করেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম এর মুখমন্ডল ছিলো প্রশস্ত, চোখ ছিলো হালকা লাল বর্ণের এবং পায়ের গোড়ালি ছিলো পাতলা। (সহীহ মুসলিম)