সিলেটে নজরুল
আবদুল হামিদ মানিক: কবি নজরুল ইসলাম। সবাই জানে তার নামটি। সাক্ষর নিরক্ষর সকলের কাছেই কবি কাজী নজরুল ইসলাম পরিচিত। তিনি বিদ্রোহী প্রেমিক কবি। কবিতা দিয়ে, হৃদয় জয় করেছেন শিক্ষিত জনের। গানের সুরে ঘরে ঘরে লাভ করেছেন সমাদর এবং অম্লান আসন। জাতীয় কবির মর্যাদা পেয়েছেন আমাদের দেশে। ঘরে ঘরে সারা উপমহাদেশে পরিচিত এই কবি নজরুল; কবি-জীবন কাটিয়েছেন কলকাতায় আর শেষ শয্যা নিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। কবি সাহিত্যিক আউল বাউল আর সুফী দরবেশের পদচারণায় ধন্য, পুণ্যভূমি সিলেটে কবি নজরুল দু’দুবার শুভাগমন করেন। দু’বারই তিনি দীর্ঘ সময়-মাসাধিক কাল থাকেন সিলেটে। গানে, বক্তৃতায় আড্ডায় মাতিয়ে রাখেন সিলেটের সংস্কৃতিসেবী আর ভক্তদের। সমসাময়িক সিলেটের লেখক সাংবাদিকদের স্মৃতিচারণায় তার সিলেট সফর এবং অবস্থানের বর্ণনা পাওয়া যায়।
কবি নজরুল। সৈনিক নজরুল। অতি অল্প সময়ে বাংলা কাব্যে ঝড় তুলেন। ফলে খুব দ্রুতই তার নামটি সিলেট সহ সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। তার ভক্ত অনুরাগীদের সংখ্যা সিলেটেও গড়ে ওঠে। কবিকে এক নজর দেখার সাধ হয় অনেকের। কবির চেহারা এবং বেশভূষাও ছিল স্বতন্ত্র। মাথায় ঝাকড়া চুল। গোলগাল চেহারা, শ্যামলা রঙ্গ, খদ্দরের পাঞ্জাবী গায়ে, পরিধানে মোটা খদ্দরের ধুতি, গলায় বড় বড় পাথরের একগাছা মালা। নজরুলের এ ধরনের চেহারা সুরতের বর্ণনা শুনেও অনেকের কৌতূহল ছিল অসীম। সবাইতো আর কলকাতায় গিয়ে কবিকে দেখে আসতে পারে না। নজরুল তার রচনার জন্যেও দেশে আলোচিত সমালোচিত। তাই সিলেটে অনেকেই নজরুলকে সামনা সামনি দেখার জন্য ছিলেন আগ্রহী।
কবি নজরুল এই প্রেক্ষাপটে আসেন সিলেটে। সে ছিল ১৯২৫ সালের শেষ অথবা ‘২৬ সালের প্রথম দিক। কবির প্রথম সিলেট সফরের তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। কবি একলিমুর রেজা এবং অধ্যক্ষ দেওয়ান আজরফের মতে সেটা ছিল ১৯২৫ সাল। কেউ কেউ বলেছেন ১৯২৬। সিলেটে কংগ্রেস দলের সদস্যদের নিমন্ত্রণে তিনি প্রথম আসেন সিলেটে। কংগ্রেসের অধিবেশনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সিলেটে আসার পর দুর্ভাগ্যবশত কবি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি নয়াসড়কে রায় বাহাদুর রমনী মোহন দাসের বাড়িতে উঠেন। কবির গায়ে জ্বর। এরই মধ্যে কবি একলিমুর রেজা এবং দেওয়ান আজরফ এক সাথে কবিকে দেখতে যান রায় বাহাদুর রমনীমোহনের বাড়িতে। দেখতে পান সারা বাড়ি লোকে লোকারণ্য। এরা সবাই কবির দর্শনার্থী। মরমী কবি হাসন রাজার পুত্র একলিমুর রেজা ছিলেন খোলামনের মানুষ। প্রায় জেদ ধরেই তিনি কবিকে নিয়ে আসেন নিজের জিন্দাবাজারের বাসায়। সাথে তিন চারজন স্বেচ্ছাসেবকও আসেন। চায়ের আয়োজন হলো। কবি একলিমুর রেজা তার দেবতার পরিণাম কবিতাটি পড়ে শোনান। নজরুল কবিতাটি শুনে মন্তব্য করেন ‘ভাই আপনি ফার্স্টক্লাস বাপের ছেলে তাই ফার্স্টক্লাস হয়েছেন। আমরা থার্ডক্লাস বাপের ছেলে আর কতদূর অগ্রসর হতে পারি।’ একলিমুর রেজাও কম যাননা। বলে উঠলেন আমি ফার্স্টক্লাস বাপের ছেলে বলেই হয়েছি থার্ডক্লাস আর তুমি থার্ডক্লাস বাপের ছেলে বলেই হয়েছো ফার্স্টক্লাস); উত্তর শুনে নজরুল তার স্বভাবসুলভ হাসিতে ফেটে পড়েন। কবি একলিমুর রেজা নজরুলকে স্বাগত জানিয়ে তিনটি কবিতা লিখেছিলেন। এর একটির শেষ লাইন :
সোনা রূপা সবই গেছে/বন ফুলের হার। লও হে কবি, দীন কবির/স্নেহ উপহার।
কবির জ্বরের তাপ তখন বাড়ছে। তাই জ্বর নিয়েই তিনি এখান থেকে রায় বাহাদুরের বাসায় চলে যান। তিন দিনের মাথায় কবির শরীরে গুটিকা বসন্ত বের হতে থাকে। এ অবস্থায় তিনি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে প্রায় এক মাস কাটান সিলেটে। সুস্থ হয়ে ফিরে যান কলকাতায়। তখনকার সময়ে ভয়ানক গুটি বসন্তে আক্রান্ত কবির প্রথম সিলেট সফর তাই তেমন জমেনি।
সিলেটে কবির অনুরাগীরা তাই খুঁজতে থাকেন সুযোগ। কিভাবে তাকে আবার সিলেটে আনা যায়। সে সুযোগ আসে ১৯২৮ সালে। সুরমা ভ্যালি মুসলিম স্টুডেন্টস এসোসিয়েশন সেপ্টেম্বর মাসে সিলেটে সম্মেলনের আয়োজন করে। এ সম্মেলনে দাওয়াত দেয়া হয় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং কাজী নজরুল ইসলামকে। তারা দাওয়াত গ্রহণ করেন। তিন জনই এক সাথে কলকাতা থেকে আসেন সিলেটে। এ উপলক্ষে ঢাক ঢোল পিটিয়ে নেয়া হয়েছিল প্রস্তুতি। অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক ছিলেন যুগবাণী পত্রিকার সম্পাদক মকবুল হোসেন চৌধুরী। মেহমানরা আসেন ট্রেনে। রেলস্টেশনে বিশাল সমাবেশ। সিলেটে উৎসাহ উদ্দীপনার জোয়ার। উদ্যোক্তাদের পক্ষে আব্দুল মুহিত চৌধুরী আগেই কুলাউড়া চলে যান তাদের এগিয়ে নিয়ে আসার জন্য।
যথা সময়ে সুরমা মেইল আসে সিলেটে। সমবেত ছাত্র জনতার মধ্যে প্রচন্ড উল্লাস। বিশিষ্ট দার্শনিক দেওয়ান আজরফ তখন টগবগে যুবক। তার বর্ণনায়-এবার কবিকে দেখাচ্ছে ঠিক বিদ্রোহী কবির মতই। মাথায় হলদে সিল্কের অপূর্ব ঢঙে বাধা পাগড়ি। গায়ে সবুজ খদ্দরের গলফকোর্ট, পরিধানে সবুজ খদ্দরের নিকাব, পায়ে সবুজ খদ্দরের তৈরি লেগ গার্ড। পদদ্বয়ে আমেরিকান টোয়ের কালো জুতো।’ নজরুল সহ অতিথিদের সমবেত সবাই বরণ করে নেয়।
সিলেটে সুরমা নদীর উপর তখনো কীনব্রিজ হয়নি। জুড়িন্দা নৌকায় পার হলেন নদী। পূর্বে তৈরি পরিকল্পনা মতো নজরুল ইসলাম উঠলেন মকবুল হোসেন চৌধুরীর দরগা মহল্লার বাসায়। শহীদুল্লাহ তার এক প্রাক্তন ছাত্র এবং শেরে বাংলা গেলেন নওয়াবী মসজিদের কাছে ডাক বাংলোয়। নজরুল বাসায় এসেই ঢুকলেন বাথরুমে। আর বেরিয়ে আসেন না। সবাই অপেক্ষমান। আধ ঘন্টা পর হাসিমুখে কবি বেরিয়ে আসেন হাতে বাথরুমে রচিত অমর একটি গান নিয়ে।
বিকেল চারটায় রাজা জিসি হাইস্কুলে সম্মেলন শুরু হবে। এই সময়ে ছিল পূজোর ছুটি। নজরুলের ভক্ত অনুরাগী সহ ডাক্তার, উকিল মোক্তার, শিক্ষক এমনকি শ্রমজীবীরাও এসে জড়ো হয়েছেন। প্যান্ডেলের নিচে বিশাল ভিড়। শুরু হল সম্মেলন। প্রকান্ড ডায়াসে আসলেন মেহমানরা। সভাপতি শেরে বাংলা, প্রধান বক্তা ডঃ শহীদুল্লাহ। নজরুল হারমোনিয়াম নিয়ে গাইলেন উদ্বোধনী সংগীত সিলেট আসার পথে রচিত-চল চল চল ঊর্ধ্ব গগণে বাজে মাদল গানটি। এটি এখন বাংলাদেশের রণসংগীত। সম্মেলনের তিনটি অধিবেশন হয়েছিল। তৃতীয় দিনে ছিল ছেলেদের ডন কুস্তি প্রদর্শনের পালা। নজরুল, ইব্রাহীম মিয়ার ডনের পদ্ধতি দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইব্রাহিম তোমার শরীর দেখে মনে হল গ্রীক ভাস্করের খোদাই করা মূর্তি।’ স্টুডেন্টস এসোসিয়েনের এ উদ্যোগের কর্মকর্তা ছিলেন আশহার আলী বিএ বিটি।
অধিবেশনের সমাপ্তির পর সিলেটে শুরু হলো দাওয়াতের পালা। মোহাম্মদ বখত মজুমদার, হাওয়া পাড়ার আব্দুল্লাহ উকিল, আমীনুর রশীদ চৌধুরী প্রমুখের বাসায়। নজরুল যেখানেই দাওয়াত খেলেন জমলো আড্ডা। জমজমাট আড্ডায় কবি গাইলেন, বিচিত্র বিষয়ে কথা বললেন। ইলু মিয়া পাহলেওয়ান দাওয়াতের আয়োজন করেন নয়া সড়কের লাল মিয়া ডাক্তার সাহেবের বাড়িতে। প্রত্যেক মেহমানকে দেয়া হয়েছিল ঘিয়ে ভাজা দুটো বড় পরোটা আর একটা করে আস্ত মুরগীর মুসল্লম। ছিল কুফতা, কালিয়া ইত্যাদি। নজরুল খেতে পারছেন না দেখে ইলু মিয়া হাত জোড় করে কবিকে বললেন ‘কাজী সাব, আরো বেশ করি খাউকা, হক্কলতা নু রইছে।’ প্রতিভাধর নজরুল ইতোমধ্যে সিলেটী ভাষা আয়ত্ব করে নিয়েছেন। এর প্রমাণ দিয়ে ইলু মিয়ার অনুরোধের উত্তরে কবি বলে উঠলেন, ‘খালি খাউকা, খালি খাউকা, আর কত খাইতাম বা, খাইতে খাইতে নু হেষে পেট ফাটি যাইব।
সিলেটে এ সফরেও কবি প্রায় মাস খানেক ছিলেন। তার যেখানে দাওয়াত হত, গান শোনার জন্য দু তিন শ লোক সেখানে জড়ো হয়ে যেতেন। কবি ঐ সফরে গানে, কথায় আড্ডায় সিলেট শহর মাতিয়ে তুলেছিলেন।
এবার তার বিদায়ের পালা। বাংলা কার্তিক মাস। সিলেটের আকাশে মৃদু মেঘমালা। অনেক লোক নদীর পারে জড়ো হলেন। তাদের চোখে মুখে বেদনার ছাপ। সজল চোখে সবাই তাকে জানালো বিদায়। তিনি অনেকের সাথেই আলিঙ্গন করলেন। ট্রেনে উঠে বসলেন কবি। ঝিকঝিক করে ট্রেন ছুটলো। ট্রেন সিগন্যাল পার হয়ে গেলেও দেখা গেল, তার হাতে একখানা রুমাল উড়ছে। স্টেশন থেকে ঘরে ফিরলো লোকজন। তাদের প্রত্যেকেরই হয়তো তখন কানে বাজছে-কবির স্বকণ্ঠে শোনা :
দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার / লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশিথে যাত্রীরা হুশিয়ার।
পূনশ্চ : কবির জন্ম ১৮৯৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় চুরুলিয়া গ্রামে। ১৯৪২ সালে অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারান। ভারতীয় সরকার কলকাতার একটি ভবনে কবিকে সপরিবারে বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়। ১৯৭২ এর ২৪ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এ বছরই তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়-কেবিনেট মিটিংয়ে। ১৯৭৬ এর ২৯ আগস্ট কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।