একজন সরলমনা বুযুর্গ এর চির বিদায়
মাওলানা সাজিদুর রহমান: মানুষ তো মরে। মরে যায়। সব মানুষই মরে। জন্মগ্রহণও করে, এক সময় মরেও যায়। আসা আর যাওয়া। এটাই স্বাভাবিক। এই আসা আর যাওয়ার দকল সামলে ওঠা- এটাও স্বাভাবিক। কিন্তু যাদের ব্যাপারে মনে-প্রাণে চাই তারা আরো কিছুদিন বাঁচুক, তারা যখন বলা-কওয়া ছাড়া অতর্কিতে চলে যায়, তখন সে দকল সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তার এ অপ্রত্যাশিত প্রস্থান বেশ কিছুদিন হৃদয়ে দগদগা দাগের মতো অনুভূত হয়। দিল জ্বলে, চোখ ঝরে। হারানোর বেদনায় খানিক থমকে দাঁড়ায় জীবন।
ঢাকাদক্ষিণের নগর নিবাসী মাও. নূরুল ইসলাম মাসুক সাহেব আমার কাছে তেমনি একজন সজ্জন মানুষ- যার ব্যাপারে মন থেকে চাইতাম তিনি আরো ক’টা দিন বাঁচুন। কিন্তু তিনি চলে গেলেন। বৃহস্পতিবার দিবাগত সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় অর্থাৎ ২২ নভেম্বর ‘১৯ ইং শুক্রবার রাতে তিনি মহান মাওলার ডাকে নাফেরার দেশে চলে গেলেন। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না কোনোদিন। ছাকাল্লাহু ছারাহু ওয়া জাআলাল জান্নাতা মাছওয়াহু। তার মৃত্যুর কিছুক্ষণ পরই অনলাইনে দেখতে পাই। মাও. মাহফুয আহমদ সাহেব বারকোটি ও মাও. ইকবাল সাহেব নগরীর মাধ্যমে সংবাদ জানতে পারি।
আমি অধম এবং মাও. আব্দুল হাফীয সমশের নগরী ঢাকাদক্ষিণ বাজার মসজিদে গিয়ে জুমআর নামায আদায় করি। আমরা মসজিদের ৩য় তলা থেকে জানাযায় শরিক হই। এতো মানুষ ছিল, মাদরাসার মাঠ এবং মসজিদের সব তলায় স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। খলীফায়ে মাদানি মাও. ইউনুস আলী শায়খে রায়গড়ি রাহ. র জানাযার পর এটি ছিল ঢাকাদক্ষিণের সর্ববৃহৎ জানাযা।
আল্লাহর বান্দাহ চলে গেলেন। আমরা যারা তার সাথে পরিচিত ছিলাম রয়ে গেলাম। আল্লাহ কখন ডাকবেন, জানি না। আল্লাহ যেন ঈমানের সাথে আমিসহ সবাইকে মৃত্যু নসিব করেন। শুক্রবারে মৃত্যু। কতো ভাগ্যবান তিনি। হাদীসে পাকের ভাষ্য মতে শহিদি মর্যাদায় সিক্ত হয়েছেন। আরেক হাদীসে আছে, শুক্রবারে মারা গেলে গোনাহগার হলেও কিয়ামত পর্যন্ত কবর আজাব মাফ হয়ে যায়। আর মাও. মাসুক সাহেব রাহ. তো কতো নেককার মানুষ ছিলেন! আল্লাহ তার দরজাতকে বুলন্দ করুন।
মাও. মাসুক সাহেব এ দারে ফানী ছেড়ে দারুল বাকায় চলে গেলেন। ঢাকাদক্ষিণ মাদরাসায় আমার উস্তাদ হয়ে আসার পর মাও. মাসুক সাহেবও উস্তাদ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তখন ছিল হযরত শায়খে রায়গড়ি রাহ. এর ইহতেমামির যামানা। সকাল ১০টার পূর্বে মাদরাসায় আসতেন। আর এশার নামায পড়ে বাড়িতে যেতেন। এটি ছিল তা দৈনন্দিন নিয়ম। ছুটির পর অফিসে বা আমার রুমেই থাকতেন বেশি। দুপুরের খানা প্রায়ই একসাথে খেতাম। মাও. হাফিয শামসুদ্দিন রাহ. শায়খ আব্দুল মতিন নাদিয়ার হুযুরও কোনো কোনোদিন দস্তরখানে শরিক হতেন।
মাও. মাসুক সাহেব ছিলেন “আহলুল জান্নাতে বুলহুন”- এর প্রতিচ্ছবি। আল্লাহর বান্দাহ খুবই সহজ সরল মানুষ ছিলেন। তার আচরণে কষ্ট পেয়েছে- এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। এবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহ-বিল্লাহর ব্যাপারে খুবই সচেতন ও নিরলস ছিলেন। তিনি একজন আহলুল্লাহ ছিলেন- এতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। যারা তার সাথে চলাফেরা করেছেন, আশা করি তাদেরও কোনো সন্দেহ থাকবার কথা নয়। তিনি পরিচিত কোনো বুযুর্গ ছিলেন না। তবে নিঃসন্দেহে তিনি গুমনাম আত্মসমাহিত বুযুর্গ ছিলেন। বিভিন্ন সময় মাদরাসায় নানা দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন। কাজ করেছেন। যা করেছেন শতভাগ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর ওয়াস্তে করেছেন। শায়খে রায়গড়ি তার ওপরে আশ্বস্থ ছিলেন এবং খুবই আস্থা রাখতেন। দুনিয়ার ধন-দৌলত, টাকা-পয়সা ও অভাব-অনটন নিয়ে তাকে হাঁ-হুতাশ করতে দেখিনি কোনোদিন। আসলে তিনি দুনিয়াবিমুখ বুযুর্গ ছিলেন। সবর ও তাওক্কুল ছিল ভরসা। তাআল্লুক মাআল্লাহই ছিল একক সম্বল। আল্লাহর বান্দার সাথে গল্প-সল্প যা হতো, দ্বীনী গল্পই হতো। আগেকার শেখ সাহেবদের গল্প বলতেন, তাদের ওয়াজ নকল করে শোনাতেন। মালিকা জিকরে তো গুয়ম- নামে অতি মূল্যবান ও অর্থপূর্ণ একটি হামদ তিনি ছাত্রযামানায় বেশি গাইতেন। কখনো আমরা তাকে এটা গেয়ে শুনানোর জন্য জোর আব্দার করে বসতাম। এই বার্ধক্যেও তিনি গাইতেন। পিনপতন নীরবতায় আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। কতো ভালো লাগতো! কতো মজা লাগতো! তা ভাষায় ব্যক্ত করতে অপারগ। আল্লাহর এতো উঁচুমানের প্রসংশামূলক ফার্সি হামদ আমি দ্বিতীয়টি শুনুনি জীবনে। তখনো তার এতো সুন্দর কণ্ঠ! কৈশোর ও যুবক বয়সে তার সুর ও কণ্ঠ কতো যে সুন্দর ছিল, আল্লাহপাকই জানেন। তিনি হামদটির অর্থ বুঝতেন। ফার্সি হওয়ায় আমরা সকল শ্লোকের অর্থ বুঝতাম না। আমরা দেখতাম, গাওয়ার সময় তার চোখ থেকে দরবিগলিত ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আমরা বিস্মিত হতাম। আল্লাহর প্রসংশায় যার হৃদয় কাঁদে, চোখের পানি ঝরে, যিনি আকুল-ব্যাকুল হয়ে যান- তিনি আল্লাহর খাস মায়ার বান্দাহ- এতে কোনো সন্দেহ নেই।
তার সারল্যে মাঝে মধ্যে আমরা ফূর্তি ও আনন্দের সাগরে ভাসতাম। একবার শিলঘাটে একটি ওয়াজ মাহফিল হয়েছিল। সেই ওয়াজে আমার প্রিয় লন্ডনপ্রবাসী উস্তাদ মাও. আব্দুল গাফফার গাগুয়ার হুযুরেরও ওয়াইজ হিসেবে দাওয়াত ছিল। এটা আমি জানতাম। তারা হাতে লিখে পোস্টার লাগিয়েছিল মসজিদের মিনারায়। পরদিন দশটায় মাসুক সাহেব আমার রুমে এসে বসলেন। বললেন- এক নতুন ওয়াইজ আসবে শিলঘাটের ওয়াজে। যেতে হবে। আমার সাথে আপনাকেও যেতে হবে। জীবনে বহু ওয়াইজের ওয়াজ শুনেছি। অনেককে চিনিও। কিন্তু এ বুযুর্গের নামও কোনোদিন শুনিনি। তার ওয়াজ শুনতে যেতে হবে। আমি বললাম, ওয়াইজের নাম কী? তিনি বললেন, মাও. আব্দুল গাফফার শায়খে গাগা। আমি শোনেই বুঝে ফেললাম। গাগুয়ার হুযুরকে ইশারায় ডেকে আনলাম। তখন আরো কে কে জানি উপস্থিত ছিলেন, এখন স্মরণে নেই। আমাদের সামনে তিনি তখনও বলছেন, গাগার শেখসাব কে? তার নাম তো জীবনেও শুনিনি। চলবেন সবাই ওয়াজ শোনে তার সাথে মোলাকাত করে আসব। আমি বললাম, গাগা লিখেছে, না কী লিখেছে ভালো করে পড়েছেন? তিনি বললেন, আরে আমি ভালো করে দু’তিনবার পড়ে এসেছি। আমি বললাম, আপনি হয়ত ভুল পড়েছেন। তিনি চ্যালেঞ্জ ছুড়লেন, যান আপনারা গিয়ে দেখে আসেন। আমি বললাম, ভুল হলে সবাইকে চা খাওয়াতে হবে। তিনি বললেন, চা আর কয় টাকার পানি, মিষ্টি খাওয়াব। আমরা তাকে নিয়ে মসজিদের মিনারার পাশে গেলাম। গিয়ে দেখি, লেখা আছে শায়খে গাগুয়া। হ্রস্ব উকারটা একটু মিটে গেছে। হলুদ কালির লেখা ছিল। ওখান থেকে দৌড়ে রুমে এসে যে পড়ল হাসির রুল, তুমুল হাসি। তিনি ও আমরা সবাই হাসতে হাসতে পেটে ব্যথা হয়েছিল সেদিন।
আজ মাও. নূরুল ইসলাম মাসুক সাহেব নেই। তার নাম উচ্চারণ করে রাহমাতুল্লাহ বলতে হচ্ছে। কিন্তু তাকে ঘিরে অনেক স্মৃতি আজো ভাস্বর ও জাগরুক রয়েছে আমাদের হৃদয়-এলবামে। আমাকে লিল্লাহ খুবই মহব্বত করতেন। আমিও তাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করতাম। আঙ্গুরায় আসার পরও আমার খবর নিতেন। তার ছেলে হাফিয আব্দুল্লাহ মাসরুর আমাদের আঙ্গুরায় পড়েছে। তার মারফতে কোশল বিনিময় হতো। কালেভদ্রে দেখা হলে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। আমিও তার বুকের স্পর্শে অনাবিল অনির্বচণীয় শান্তি অনুভব করতাম। আল্লাহওয়ালাদের বুক বলে কথা!! কাঁদতেন, পরকালভীতির কথা বলতেন। সুযোগে আমি তার কাছে দোয়া চাইতাম। বলতাম, হাত না তোলে এখনই আমার জন্য মনে মনে দোয়া করুন। তিনি দোয়া করতেন। তার দোয়ায় মনে হতো, আমি সাত রাজার ধন পেয়ে গেছি। এমন শান্তি অনুভব করতাম মনে।
আমার কিছু নেই! আমি নাখান্দা এক কমীনাহ! আমার আসাতেজায়ে কেরামসহ এসব সাত্বিক গুমনাম বুযুর্গদের সাথে কিছু সম্পর্ক আছে। সুযোগে তাদের খেদমতে কিছুক্ষণ বসি, দোয়া চাই। তাদের অন্তর থেকে ভালোবাসি। এই-ই সামানা। আর কিছু নেই আমার!! “আল মারয়ু মাআ মান আহাব্বা।” এটাকেই আমি নাজাতের উসিলা মনে করি।
ﺃﺣﺐ ﺍﻟﺼﺎﻟﺤﻴﻦ ﻭﻟﺴﺖ ﻣﻨﻬﻢ
ﻟﻌﻞ ﺍﻟﻠﻪ ﻳﺮﺯﻗﻨﻰ ﺻﻼﺣﺎ
মাও. মাসুক সাহেব!
আল্লাহর রহমতের ছায়ায় আশা করি ভালো আছেন। ঐকান্তিকভাবে কামনা করি খোশ ও খুররম থাকুম। হুর ও গিলমান বেষ্টিত আনন্দঘন উদ্যানে থাকুন অসীম অনাদি অনন্তকাল। আপনাদের রূহানি ফায়জ ও বরকত যেন আমাদের নসিব হয়- এই দোয়া চাই আল্লাহর দরবারে।
লেখক: মুহাদ্দিস আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর মাদ্রাসা
২২ নভেম্বর ২০১৯ ঈসায়ি