বিশেষ প্রতিবেদন

ঘরে-বাইরে দিশেহারা মিয়ানমার

মিয়ানমারে সামরিক ও বেসামরিক উভয় শ্রেণির শীর্ষ নেতৃত্ব এখন আন্তর্জাতিক আদালতগুলোতে মামলার মুখে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তিনদিনের ব্যবধানে আলাদা আদালতে তিনটি সম্পর্কহীন মামলা হয়েছে। সবগুলোতেই ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর থেকে সামরিক অভিযানের সময় সংঘাতপীরিত রাখাইন রাজ্যে অভিযানের জন্য মিয়ানমারের সরকার ও দেশটির সামরিক নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। প্রথম মামলাটি হয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে)। এর ফলে মিয়ানমার সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হতে হয়েছে। এর পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরের বেশকিছু বিষয়ও চাপে ফেলেছে মিয়ানমার সরকারকে।

রাখাইন সংকট সমাধান করা এবং সেনাবাহিনীকে তাদের কৃতকর্মের জন্য বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থতার কারণে ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে আছে মিয়ানমার সরকার। রাখাইন সংকট যে অনিবার্য সংঘাত হিসেবে এগিয়ে আসছে, তা কয়েক মাস ধরেই এড়িয়ে যাচ্ছিল দেশটি।

মিয়ানমার সরকার ও সামরিক নেতারা বারবার জাতিগত শুদ্ধি অভিযান ও গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সরকার বলছে, বিদ্রোহ থেকে নিজেদের রক্ষা করেছে তারা। জাতিসংঘের আনা জোরপূর্বক উচ্ছেদ, মুসলমানদের ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা, ধর্ষণ ও গণহত্যাসহ তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোকে বাড়াবাড়ি বলে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা।

জাতিসংঘে মুসলমান দেশগুলোর সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) এবং পাশ্চাত্যের দেশ ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমন্বিত আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়েছে মিয়ানমার। তবে রাশিয়া ও চীনের ভেটো শক্তি থাকার কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সুরক্ষা পেয়েছে দেশটি। কিন্তু চলতি মাসে দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) পশ্চিম আফ্রিকার মুসলমান দেশ (ওআইসির সদস্য) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলাটি শুনানির জন্য গ্রহণ করেছে। এই মামলার লক্ষ্য মিয়ানমারকে অভিযুক্ত করা। মিয়ানমার সত্যিই জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে কিনা, তা তদন্ত করবে আইসিজে। জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর প্রচারণা চালানোর জন্যও মিয়ানমারের নিন্দা করতে বলেছে গাম্বিয়া।

আইসিজের মামলাটি অনেকাংশেই ২০১৮ সালের আগস্টে জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনের আলোকে অভিযোগ আনা হয়েছে। আরজিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনী গণহত্যার উদ্দেশেই অভিযান চালিয়েছিল। আর যাতে গণহত্যা না হয়, সে ব্যাপারে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেও আহ্বান জানিয়েছে গাম্বিয়া। মিয়ানমারে বিদ্যমান পরিস্থিতির আর যাতে অবনতি না ঘটে, সেজন্যও দেশটির প্রতি নির্দেশ দিতে আইসিজের কাছে আবেদন জানিয়েছে গাম্বিয়া। মিয়ানমারের ঘটনার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত না হয়েও গাম্বিয়া দাবি করেছে, জেনোসাইড কনভেশন চুক্তি অনুযায়ী তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওইসব অপরাধের জন্য বিচার চাওয়ার অধিকার রাখে।

ইয়াঙ্গুনভিত্তিক এক এশিয়ান কূটনীতিক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মিয়ানমার সরকারকে এই শুনানিতে সাড়া দিতে হবেই। সরকার একে অগ্রাহ্য করতে পারবে না। আর মনে হচ্ছে, আত্মপক্ষ সমর্থনের কৌশল নির্ধারণ করতে সরকারও সময়ের অপচয় করেনি। কূটনীতিকরা বলেছেন, কেবল এতেই আন্তর্জাতিক চাপ থেকে সরে আসতে পারবে না মিয়ানমার। তাদের মতে, এখনই মিয়ানমারের ওপর কোনো শাস্তি হবে না। মামলাটির মীমাংসা হতে ১০ থেকে ১৫ বছর লেগে যাবে। তত দিনে সবকিছু ঠিক করার সময় পেয়ে যাবে মিয়ানমার।

রাখাইন রাজ্যের সমস্যা কিন্তু কেবল রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত নেই। সেখানকার সব ধর্মের লোকদের মধ্যেই এর প্রভাব পড়েছে। রাখাইন অঞ্চল এখন তরুণশূন্য হয়ে পড়েছে। রাখাইন গ্রামগুলোতে এখন বুড়ো আর শিশুরা রয়েছে। বাকিরা অর্থনৈতিক সুযোগের সন্ধানে অন্য কোনো স্থানে সরে গেছে। ফলে রাখাইনে নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়েছে। কারণ দিনমজুর পাওয়া যাচ্ছে না। গত তিন বছর ধরে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। নির্মাণ কাজের সস্তা শ্রমিক ছিল তারাই। আবার মাছপ্রিয় সিত্তুই ও ইয়াঙ্গুন মাছের অভাবে ভুগছে। বিশেষ করে রাখাইনের শুঁটকি মাছ তাদের খুবই প্রিয় খাবার। সেটা এখন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া যে পর্যটনশিল্প বিকাশ হতে চলেছিল, সেটিও মুখ থুবড়ে পড়েছে। আবার অ্যালকোহলের আসক্তি বাড়ছে রাখাইনে। তাছাড়া মাদকাসক্তিও বাড়ছে। নিজ দেশের এই সমস্যাগুলোও এখন চিন্তায় ফেলে দিয়েছে সরকারকে। বলা যায়, ঘরে-বাইরের এসব চাপে এখন দিশেহারা দেশটি। -সাউথ এশিয়ান মনিটর

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button