শায়খুল হাদীসের বিরুদ্ধে এ কেমন অপপ্রচার!
একজন কিংবদন্তি শীর্ষস্থানীয় বুজুর্গ মৃত্যুর পরও হলুদ মিডিয়ার মিথ্যাচার থেকে রেহাই পেলেন না
ডক্টর তুহিন মালিক: বিষয়টি খুবই হৃদয় বিদারক! বড়ই নির্মম! একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হককে (রহ.) জঙ্গিনেতা আখ্যা দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছে! উপমহাদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই শীর্ষস্থানীয় আলেমে-দ্বীনকে হুজির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্বদানকারী আখ্যায়িত করে এহেন প্রতিবেদন প্রচার গণমাধ্যমের পেশাদারি দায়িত্বের প্রতি চরম অবহেলা, ধৃষ্টতা ও মূর্খতার শামিল। দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে ‘শায়খুল হাদীস’ নামটা উচ্চারণ করলে যার নামটা ভেসে উঠে, সেই আল্লামা আজিজুল হককে (রহ.) জঙ্গি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা বানিয়ে এহেন মনগড়া অপপ্রচার দেশবাসীর মনে তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা, নিন্দা ও প্রতিবাদের জন্ম দিয়েছে!
শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) গণমানুষের কাছে শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্মানীত একটি নাম। তিনি ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান ছিলেন। চারদলীয় জোটের চার নেতার একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ও আমীর ছিলেন। তিনি ছিলেন এদেশের ইসলামী রাজনীতির একজন মহান সংস্কারক। অথচ এরকম একজন কিংবদন্তি মরহুম শীর্ষস্থানীয় বুজুর্গ উনার মৃত্যুর পরও হলুদ মিডিয়ার মিথ্যার হাত থেকে রেহাই পেলেন না!
আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা ও আমির ছিলেন। সেই দলটি বাংলাদেশ সরকারের সকল নিয়ম কানুন মেনে নির্বাচন কমিশনের একটি নিবন্ধিত বৈধ ইসলামী দল। রাষ্ট্রীয়, আন্তর্জাতিক কিংবা অন্য যেকোনো জায়গা থেকে আজ অবধি আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) কিংবা তার দলের বিরুদ্ধে এহেন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার নূন্যতম কোনো অভিযোগ উঠেনি। তাই বুখারীর প্রথম বাংলা অনুবাদকারী সর্বজনশ্রদ্ধেয় শায়খুল হাদীসকে জঙ্গিনেতা আখ্যা দিয়ে মিথ্যা বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রচারের জন্য ওই টিভিকে অবশ্যই নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না যে এটা দেশে বিদ্যমান গণমাধ্যম আইন ও সম্প্রচার নীতিমালাসহ, প্রচলিত ফৌজদারি আইন এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
আসলে আমাদের নতুন প্রজন্মসহ দেশের উদীয়মান সংবাদকর্মীরা এদেশের সর্বজনশ্রদ্ধেয় আলেম-ওলামাদের আকাশচুম্বী সম্মান, ত্যাগ ও দেশপ্রেম সম্পর্কে হয়ত সঠিকভাবে কিছুই জানে না। তারা হয়ত জানেই না, পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের কুরআন-সুন্নাহবিরোধী পারিবারিক আইনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন এই শায়খুল হাদীস।
তাদেরকে হয়ত মনে করতে দেয়া হয় না, বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও ভারতের মুসলমানদের উপর গণহত্যার প্রতিবাদে ১৯৯৩ সালে ঐতিহাসিক লংমার্চের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই শায়খুল হাদীস। তাদেরকে হয়ত এটাও জানতে দেয়া হয় না যে, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাও বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইলে এই আল্লামা শায়খুল হাদিস (রহ.) ঘোষণা করেন ‘বাবরী মসজিদ পূণঃনির্মাণ এবং ফারাক্কা সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নরসীমা রাও বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত।’
তারা এটাও হয়ত জানেও না, রাষ্ট্র বা ইসলামবিদ্বেষী মহল যখনই ষড়যন্ত্র করেছে, শায়খুল হাদীস (রহ.) তখনই অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার সাথে তাদের প্রতিহত করেছেন। এজন্য উনাকে বহুবার কারারুদ্ধ হতে হয়েছে। বহু নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আর উনি দৃঢ়তার সাথে লড়াই করে বলতেন- ‘দ্বীন ধ্বংস হবে আর আমি বসে থাকব?’
আজকের এই উদীয়মান সংবাদকর্মীরা হয়ত স্মরণ রাখতে চায় না, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ কিন্তু এই শায়খুল হাদীসের সাথেই ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য পাঁচ দফার রাজনৈতিক চুক্তি করেছিলেন। তাই স্বভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে, শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহঃ) যদি জঙ্গি প্রতিষ্ঠাতা হন, তাহলে উনার সাথে রাজনৈতিক চুক্তিকারী আওয়ামী লীগও জঙ্গি!
আসলে বর্তমান সময়ে সীমাহীন অন্যায় অবিচার এবং আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে আল্লামা শাহ আহমেদ শফী (দা. বা.), আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম, আল্লামা মামুনূল হক, মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীসহ যেসব শ্রদ্ধেয় দেশবরেন্য আলেম-ওলামা দুর্দমনীয়ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের (রহ.) পুত্র অাল্লামা মামুনূল হকের বিপ্লবী সত্যকন্ঠকে রুদ্ধ করার জন্যই উনার সর্বজনশ্রদ্ধেয় মরহুম পিতার সম্মানকে বিতর্কিত করতে উঠে পড়ে লেগেছে কিছু দালাল চক্র।
তাই জাতি আশা করে, জনপ্রিয় ওই টেলিভিশন চ্যানেলটি তাদের পেশাগত দায়িত্ববোধ অক্ষুণ্ণ রাখবে। তারা কিছু চিহ্নিত হলুদ দালাল মিডিয়ার মতো দেশের প্রয়াত আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে এহেন অপমানজনক মিথ্যা বিভ্রান্তিকর তথ্য ও প্রতিবেদন প্রকাশ করা থেকে নিবৃত্ত থাকবে। কেননা এমনিতেই আমাদের মূলধারার গণমাধ্যম আজ সাংঘাতিকভাবে আস্থাহীনতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এমতাবস্থায় যমুনা টিভির মতো জনপ্রিয় একটি চ্যানেলও যদি এভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রয়াত আলেম-ওলামাকে নিয়ে এহেন মিথ্যা অপমানজনক তথ্য প্রচার করে, তাহলে এটা শুধু একা সংশ্লিষ্ট চ্যানেলটিরই ক্ষতির কারণ হবে না। বরং দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের বিশ্বাসের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণমাধ্যমের মর্যাদায় মারাত্মকভাবে আঘাত হানবে। আশা করি আমরা নবীদের আদর্শিক উত্তরাধিকারী সম্মানীত আলেমদের সুউচ্চ মর্যাদা অনুধাবন করতে সক্ষমতা অর্জন করবো। আশা করি সংশ্লিষ্ট টিভি কর্তৃপক্ষ ভুল স্বীকার করে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
-লেখক: আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ