স্যার ফজলে হাসান আবেদ: এক অতুলনীয় বিপ্লবীর নাম
নজরুল ইসলাম বাসন: ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন দেশের হতাশ শিক্ষিত তরুন-যুবক-ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, একাউটেন্ট এর পেশাজীবীরা এমন কি মুক্তিযোদ্ধারাও দেশ ছাড়ছিলেন তখন একজন ফজলে হাসান আবেদ বিলাসি জীবনকে বিদায় জানিয়ে লন্ডনের ফ্লাটটি বিক্রি করে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন আজকের বৃহত্তর সিলেটের শাল্লা গ্রামে, শাল্লা বাংলাদেশের অত্যন্ত দুর্গম ও অনুন্নত ও দারিদ্র-পীড়িত এবং হিন্দু অধ্যুষিত একটি এলাকা, যেখানকার মানুষ পাক-সেনাদের আক্রমনের মুখে ইন্ডিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিল, দেশ স্বাধীন হলে তারা যখন দেশে ফিরে আসল তখন সহায় তারা সহায় সম্বলহীণ মাথা গোজার ঠাই নেই।
বিলেত ফেরত ফজলে হাসান আবেদ তাদের পাশে দাড়ালেন সেখান থেকেই শুরু করলেন তার যাত্রা, ব্রাক ছিল তার সেদিনের নতুন সংগ্রাম। ভাঙা-চুরা চেয়ার -টেবিল, পরিত্যক্ত দোকান ঘর, গোয়ালঘর কিংবা হাসপাতালের কক্ষতে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ৫ জন সহকর্মী নিয়ে কাজ করতেন শেল বহুজাতিক কোম্পানির ভুতপূর্ব হেড অফ ফাইন্যান্স ফজলে হাসান আবেদ। চারমিনার ছেড়ে তখন তিনি স্টার ধরেছিলেন বলে এক লেখায় পড়েছি, স্যার ফজলে হাসান আবেদ ঐ জীবন বেছে নিয়েছিলেন। এ যেন আরেক যুদ্ধ, চে গুয়েভারা কিউবার বিপ্লব শেষ করে বলিভিয়ায় চলে গিয়েছিলেন, আর ফিডেল ক্যাস্ট্রো হাল ধরেছিলেন কিউবার। ফজলে হাসানের যুদ্ধ ছিল শ্রেনীহীন বা ডি-ক্লাশড হওয়ার যুদ্ধ। গ্রাম থেকে তিনি উঠে এসেছেন শহরে। ধ্বংশস্তুপ থেকে প্রাসাদ নির্মান করেছেন তিনি, তিনি শুধু বিদেশের অনুদান নেননি বরং বিদেশীদের নিকট থেকে সম্মান বয়ে এনেছেন দেশের জন্যে পেয়েছেন র্যামন ম্যাগাসাস এওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড ফুড এওয়ার্ড, ইউএনডিপি এওয়ার্ড, স্যার ইত্যাদি উপাধি। এ যেন একটি ছায়াছবি ব্লাক এন্ড হোয়াইট থেকে কালার মুভি, বিশ্ববিখ্যাত এডুকেটর পাওলো ফ্রেয়ারার এর পেডাগজি অফ দি অপ্রেস অথবা জন পিলজারের ফ্রিডম নেক্সট টাইম বা চমস্কির লেখা বা জ্যাক ফ্রেসকো এর ভিনাস প্রজেক্ট পড়লে ভেসে উঠে স্যার ফজলে হাসান আবেদের মুখ। শেল ওয়েলের বড় চাকুরি নিয়ে ইস্ট পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলে ফজলে হাসান আবেদ ফাইন্যান্স বিভাগের প্রধানও হয়েছিলেন, ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘুর্নিঝড় এ মৃত্যুও ভয়াবহতা তাকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিল ঝাপিয়ে পড়লেন ত্রান কার্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগের রেশ শেষ হতে না হতে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্যার ফজলে হাসান আবেদ লন্ডন থেকে এ্যাকশন বাংলাদেশ এর ব্যানারে কাজ শুরু করলেন বিলেত থেকে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে কাজ করে যেতে লাগলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর পর স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশে চলে গেলেন।
সিলেটের বানিয়াচঙ্গের হাসান পরিবারের সন্তান ১৯৩৬ সালে বাবা সিদ্দিক হাসান ও মা সুফিয়া খাতুনের গর্ভে ২৭ এপ্রিল জন্ম গ্রহন করেন, পাবনা জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন, ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বৃটেন যান লেখাপড়া করতে গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি তে নেভাল আর্কিটেকচাওে পড়ার জন্যে। লন্ডন থেকে চ্যাটার্ড ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজম্যান্ট একাউন্টস শেষ করেন সেই ১৯৬২ সালে। তখন সারা বিশ্বে রুশ-চীন আর কিউবা বিপ্লবের ঝড়, মাও সে তুং, চে গুয়েভারা তখন বিশ্বের বিপ্লবিদের নাড়া দিচ্ছেন। মনে মনে বিপ্লবি ছিলেন ফজলে হাসান আবেদ তিনি এডুকেটর পাওলো ফ্রেয়ার এর পেডাগজি অফ অপ্রেসড: বই পড়ে অনুপ্রানিত হলেন পাওলো ফ্রেয়ার উন্নয়নের জন্যে জনগনের ক্ষমতায়নের উপর জোর দিয়েছিলেন তত্ব দিয়ে। ফজলে হাসান আবেদ বাস্তবায়ন করতে লাগলেন থিওরি থেকে প্রাকটিশে। বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার সহকর্মী আহমেদ মোশতাক চৌধুরি কে নিয়ে গড়ে তুললেন গবেষনা ও মূল্যায়ন বিভাগ। ব্রাকের ইর্ষণীয় সফলতার পেছনে রয়েছে প্রশিক্ষন, গবেষনা ও মুল্যায়ন এবং তদারকি, ব্রাকের ওরাস্যালাইন গবেষনার এক যুগান্তরি ফসল। অপর দিকে শুরু থেকেই জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করতে ব্রাকের ফিন্যান্স বিভাগ, অডিট ও মনিটারিং বিভাগকে দক্ষ লোকবল দিয়ে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে যে, বিশ্বের যে কোন প্রতিষ্ঠান বা সরকারের জন্য তা উদাহারন হয়ে থাকতে পারে। শুধু বিদেশি সাহায্যও উপর নয় নিজের পায়ে ব্রাক কে দাড় করানোর জন্যে তিনি প্রিন্টিং প্রেস, ক্ষুদ্র ঋণ, পোলট্রি, আড়ঙ, ডেইরি ইত্যাদির পাশা পাশি ব্রাক ব্যাংক, ব্রাক ইউনিভার্সিটিও প্রতিষ্ঠা করেন। জানা যায় ব্রাকের বার্ষিক বাজেট ১০ হাজার কোটি টাকা।
স্যার আবেদ বর্তমানে যে অবস্থানে এসেছেন তার পথ পরিক্রমা খুব সহজ ছিল না কিন্তু বিজ্ঞান মনস্ক এই মানুষটি ৬৯ হাজার গ্রামে ব্রাকের কর্ম কার্যক্রম বিস্তৃত করেছেন, ১১০ মিলিয়ন মানুষ ব্রাকের সেবা গ্রহন করে যাচ্ছে। ২০০২ সাল থেকে ব্রাক আফগানিস্তান সহ এশিয়া ও আফ্রিকার ১০টি দেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে, অতি দরিদ্রদের দারিদ্র মোচনে ব্রাকের মডেল এখন অন্যান্য দেশে অনুসৃত হচ্ছে। গত ২৭ এপ্রিল ছিল স্যার আবেদের ৮০ তম জন্ম বার্ষিকী তার জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকার দৈনিক প্রথম আলো অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবুল মুহিতের একটি লেখা ছাপিয়েছে, সম্পাদক মতিউর রহমান একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এ ছাড়াও শিক্ষাবিদ জামিলুর রাজা চৌধুরি, অধ্যাপক আবুল বায়েসও লিখেছেন এই কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিত্বেও উপর, স্যার আবেদ শুধু ব্যাক্তি নয় এখন একটি প্রতিষ্ঠানে নিজেকে রুপান্তরিত করেছেন তার পদাংক অনুসরন অনেকে এগিয়ে আসতে পারেন এ কথা আমি বিশ্বাস করি। মুক্তিযুদ্ধের পর যেখানে রোল মডেলের দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে আশীর্বাদ আর আনুগত্যের কাছে যখন ডান-বাম মিলে একাকার হয়ে গেছে তখন মাথা তুলে দাড়ানোর কথা শিখিয়েছেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। নারীদের ক্ষমতায়ন, অতি দরিদ্রদের দারিদ্র বিমোচন করে টিম ওয়ার্ক করে দেখিয়েছেন আমরাও পারি। বাংলাদেশ যে নেতৃত্ব দিতে পারে ব্রাক সে পথ দেখিয়েছে।
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সাবেক সম্পাদক – সাপ্তাহিক সুরমা