হালাল রিজিকের গুরুত্ব

মাওলানা আব্দুল হান্নান তুরুকখলী: হালাল-হারাম বিষয়টির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কোনটি হালাল আবার কোনটি হারাম সে বিষয়টিও আমাদের সামনে দিবালোকের ন্যায় পরিষ্কার। হালাল কোনটি আর হারাম কোনটি সে বিষয়ে আমরা সবিশেষ অবগত হওয়ার পরও হালালের প্রতি আমাদের মোটেই আকর্ষণ নেই। আমরা হারাম রিজিকের তালাশে ব্যস্ত-মহাব্যস্ত। আমরা হালাল রিজিক তালাশের কল্পনাও করিনা কিন্তু হারাম রিজিকের জন্য মহাশূন্যে উড়ে যেতে চাই। হারাম রিজিকের জন্য আমরা জীবন বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করি না। হালাল খাদ্যে আমরা তৃপ্তিবোধ করিনা, এতে আমরা তুষ্ট হইনা। হালাল অল্প হলেও এতে বরকত আছে। একথাটি আমরা বুঝিনা, বুঝার চেষ্টাও করিনা। হালাল রিজিকের মধ্যে যে আমাদের সকল কল্যাণ নিহিত রয়েছে তা যদি জানতাম তাহলে আমরা হালাল রিজিকের সন্ধানে সর্বদা লেগেই থাকতাম।
মানব জীবনে হালাল রিজিকের গুরুত্ব অপরিসীম। হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ। হালাল ভক্ষণ না করলে দোয়া ও ইবাদত কবুল হয়না। হালাল হতে দান না করলে দানও কবুল হয়না। হালাল রিজিক সর্বোত্তম রিজিক। হালাল রিজিক তালাশ করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘অতঃপর যখন নামাজ সমাপ্ত হয়, তখন তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) অন্বেষণ কর’ (সূরা জুমআ: আয়াত-১০)। আল্লাহপাক সকল নবী-রাসূলগণকে হালাল খাদ্য খেতে নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর’ (সূরা মুমিনুন: আয়াত-৫১)। হালাল খাদ্য আহার করলে মানুষের অন্তর ও দেহ পবিত্র হয়। তাই সর্বদা হালাল পবিত্র বস্তু আহার করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন-‘হে মানবমন্ডলী! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র খাদ্যবস্তু রয়েছে তা হতে তোমরা আহার কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করোনা, নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’ (সূরা বাকারা : আয়াত-১৬৮)। অন্য আয়াতে ইরশাদ হচ্ছে ‘আল্লাহ তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তন্মধ্যে যা হালাল ও পবিত্র তা তোমরা আহার কর’ (সূরা নাহল: আয়াত-১১৪)।

কোন বস্তু আহার করতে হলে তা হালাল কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। কারণ হালাল বস্তুর সাথে সামান্যও হারাম যুক্ত হলে বা হারাম মিশে গেলে তা হারামে পরিণত হয়ে যায়। যেমন খাদ্য ভর্তি একটি পাত্রে এক ফোটা কেরোসিন পড়ে গেলে সমস্ত খাদ্যই দূষিত হয়ে যায়, সমস্ত খাদ্যই খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। হালাল-হারামের বিষয়টিও অনুরূপ। হালালের সাথে একটুও হারাম মিশ্রিত হলেই তা হারামে পরিণত হয়ে যায়। সরকারি চাকুরিজীবীদের কথা এখানে প্রথমেই এসে যায়। সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা অনেক কষ্ট করে চাকুরি করেন। কিন্তু ঘুষ গ্রহণ করেন না-এমন কর্মচারী-কর্মকর্তা পাওয়া বিরল। অনেক সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা আছেন যাদের মাসের পর মাস বেতনের টাকা উঠাতে হয়না। ঘুষের টাকা দিয়েই মাসের পর মাস, বছরের পর বছর সংসারের খরচাদি চলে। সেই ঘুষের টাকায় তারা তাদের ছেলেমেয়েদের ভরণ-পোষণ চালান। মানুষ গড়ার কারিগর নামের শিক্ষকদের অবস্থাও একই। অনেক শিক্ষক দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বেতন ভোগ করে থাকেন। আর এভাবেই হালাল রুজির সাথে হারাম মিশ্রিত হয়ে যায়। কষ্ট করে চাকুরি করেও হালাল খাদ্য খাওয়া সম্ভব হয়না। কারণ ঘুষের টাকা দিয়ে, ফাঁকিবাজির টাকা দিয়ে হালাল খাদ্য কিনবেন কিভাবে, হালাল খাদ্য খাবেন কিভাবে? সুদের ভয়াবহ পরিণামের কথা কারো অজানা নয়। অনেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যাংকে জমা রাখেন। ব্যাংক তাদেরকে শতকরা ৮/১০ টাকা হারে সুদ দেয়। এই সুদের টাকা দিয়েই চলে অনেকের সংসার। দুঃখজনক বাস্তব ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের যারাই সুদ ও ঘুষের সাথে জড়িত তারা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। এরা অনেকে বুদ্ধিজীবী বলেও পরিচিত। এরা কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম এর প্রতি মোটেই ভ্রুক্ষেপ করেন না। হারাম উপায়ে কিভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা যায় তার সকল পদ্ধতি এরাই প্রণয়ন করে থাকেন। এদের সামনে হালাল খাদ্যের উপকারিতার কথা বললে উপহাস করে থাকেন। প্রশ্ন হল-যে সমাজের বুদ্ধিজীবীরা হারাম উপার্জনের জন্য মহাব্যস্ত সে সমাজের সাধারণ লোকেরা যাবে কোথায়? এরা হালাল খাদ্য পাবে কোথায়?
আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম সৎ, মহৎ ও আদর্শবান হোক এটা আমরা সকলে চাই। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম তো আমাদের রক্ত-মাংস থেকেই উৎসারিত হবে। এখন আমাদের রক্ত-মাংস যদি হারাম খাদ্য দ্বারা নষ্ট করে দেই তাহলে আমাদের রক্ত-মাংস থেকে কি সৎ ও মহৎ প্রজন্ম পাবার আশা করতে পারি? মাতাপিতা হারামের পূজারি হলে সন্তান ভাল হবে কিভাবে? নেতা হারামের পূজারি হলে জনতা ভাল হবে কিভাবে? সব হারাম খাদ্যের মূলে কুঠারাঘাত করে সর্বাবস্থায় আমাদেরকে হালাল রিজিক অন্বেষণে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে। সর্বাবস্থায় হালাল রিজিক আহার করলে, হালাল উপার্জনের ধ্যান-ধারণা আমাদের মধ্যে থাকলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মও সৎ, মহৎ ও আদর্শবান হয়ে উঠবে। সমাজ ও রাষ্ট্রে সর্বদা শান্তি বিরাজ করবে।
দেহ ও মন পবিত্র করার একমাত্র মাধ্যম হলো হালাল রিজিক। ইবাদত কবুল হওয়ার এবং দোয়া কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে হালাল রিজিক। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সৎ ও মহৎ করে গড়ে তুলতে হালাল রিজিকের বিকল্প নেই। তাই সর্বাবস্থায় হালাল রিজিক অন্বেষণে এগিয়ে আসা আমাদের সকলের উচিত।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button