ইকোনমিস্টের ব্যাখ্যা : পশ্চিমারা কেন ইসলাম গ্রহণ করছেন?
প্রতি বছর অন্তত ৫ হাজার ২০০ ব্রিটিশ নাগরিক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছেন। বিগত বছরগুলোতে ব্রিটেনের প্রায় ১ লাখ নাগরিক ইসলামকে আলিঙ্গন করেছেন। আমেরিকায় এই সংখ্যা কয়েক লাখ।
এখন প্রশ্ন হলো—পশ্চিমারা কেন ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর পত্রিকাটির অনলাইনে প্রকাশিত ‘হাউ মেনি পিপল কনভার্ট টু ইসলাম’ শিরোনাম শীর্ষক সেই প্রতিবেদটি প্রকাশ করা হলো :
কেনিয়ার নাইরোবির ওয়েস্টগেট হামলায় ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্রিটিশ নাগরিক সামান্থা লিউথওয়েটের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে সন্দেহ দিনকে দিন বাড়ছেই। এছাড়া ইন্টারপোল এবং কেনিয়ার পুলিশ এরই মধ্যে ভিন্ন আরেকটি বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
মিস লিউথওয়েটে এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তার মেয়ে। যিনি বড় হয়েছেন কয়েকটি ইংলিশ হোম কাউন্টিতে এবং কৈশোরেই ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তিনি যাকে বিয়ে করেছিলেন, তিনিও একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান।
আর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই বেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য। দেখা গেছে, যারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন, তাদের সবাই মুসলিমদের সঙ্গে অন্তত বেশ কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। মুসলিমদের জীবনাচরণ সম্পর্কে অন্তরঙ্গভাবে মিশে জানেন। এরপরই তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন।
আর ব্রিটেনে ইসলামে ধর্মান্তরিত জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশই নারী। নারীদের বেশিরভাগই একজন মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করতে চান বলে নিজের ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামে আসেন।
এর বাইরে যারা ধর্মান্তরিত হচ্ছেন, তাদের ভাষায়—‘ব্রিটিশ সমাজের পাপাচারে তারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।’ অনেকে আবার ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণ হিসেবে সামাজিক সহানুভূতি (কমিউনিটি সেন্স) সন্ধানের কথা বলেছেন।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশটির জেলখানাগুলো হলো ব্রিটিশ পুরুষদের ইসলামে ধর্মান্তকরণের সবচেয়ে উর্বর ক্ষেত্র। অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, জেলখানা থেকে যারা ইসলাম গ্রহণ করছেন, তারা বিপ্লবী প্রবণতার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন।
অনেকে আবার বলেন, ইসলামের শৃঙ্খলা এবং কাঠামোর পাশাপাশি অন্য মুসলিমদের কাছ থেকে তারা যে সহায়তা পান—তা তাদের বন্দি জীবনযাপনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে।
ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা গণনা করাটা একটু সমস্যাই বটে। ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের জরিপের সময় ধর্মান্তরিতদের তাদের আগের ধর্মের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। ব্রিটিশ মসজিদগুলোও ধর্মান্তরিতদের কোনো কেন্দ্রীয় তালিকা সংরক্ষণ করে না।
অনেক ধর্মান্তরিত ব্যক্তি তাদের নতুন ধর্ম গ্রহণের বিষয়টি তাদের বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে গোপনও রাখেন। তবে ইউনিভার্সিটি অব ওয়েলসের ট্রিনিটি সেইন্ট ডেভিডের গবেষক কেভিন ব্রাইস বলেন, ‘মসজিদগুলোকে সরবরাহ করা প্রশ্নপত্র থেকে এ হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর অন্তত ৫ হাজার ২০০ ব্রিটিশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হচ্ছেন এবং এখন পর্যন্ত এদের মোট সংখ্যা প্রায় ১ লাখ।’
আমেরিকায় ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা গণনা করাটা আরও কঠিন। কারণ আমেরিকার আদমশুমারিতে ধর্ম সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হয় না। আর খুব কম মসজিদই তাদের সদস্যদের লিখিত তালিকা সংরক্ষণ করে। এর ফলে সেখানে মুসলিমদের মোট সংখ্যা কত—তা জানাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
২০০৭ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক হিসাবে দেখা গেছে, আমেরিকায় প্রায় ২৪ লাখ মুসলিম রয়েছে। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬০ লাখ মুসলিম রয়েছে। পিউয়ের ধারণা, সেখানকার মুসলিমদের এক-চতুর্থাংশেরও কম ধর্মান্তরিত মুসলিম। আর এদের বেশিরভাগই আফ্রিকান আমেরিকান।
অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেন, ধর্মান্তরিত মুসলিমরাই চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। কারণ তারা ধর্মের বিভিন্ন ঐতিহ্য সম্পর্কে খুব সামান্যই জ্ঞান রাখেন। তবে লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামে ধর্মান্তকরণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লিওন মুসভি বলেন, ‘এই ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়।’ তিনি বলেন, ‘ধর্মান্তরিতদের প্রধান সমস্যা হলো সামাজিক সহায়তার অভাব। অনেক ধর্মান্তরিতই তাদের পরিবার থেকে বিতাড়িত হন। তারা এমনকি মূলধারার মসজিদগুলোতেও গৃহীত হন না।’
ব্রিটেনে এ ধরনের মসজিদগুলো অনেকটা নৃগোষ্ঠীেগত ক্লাবের মতো কাজ করে। এভাবে নিঃসঙ্গ হয়ে যাওয়ার ফলে তারা চরমপন্থীদের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। এরা সাধারণত আশা করে, শ্বেতাঙ্গ ধর্মান্তরিতরা তাদের সহায়তা করবে। কিন্তু যেসব ধর্মান্তরিত সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যেমন মিস লিউথওয়েটে যেমনটা করছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে—এরা খুবই বিরল।
প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ শান্তিবাদী ধর্মান্তরিতরাই মুসলিম এবং অন্যদের মধ্যকার যে দূরত্ব রয়েছে, তা লাঘব করতে সক্ষম। পশ্চিমা দেশগুলোতে ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি বিদেশি ধর্ম থেকে ইসলাম ক্রমাগত স্বদেশজাত ধর্মে পরিণত হচ্ছে।