মাত্র ৫০০০ পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস
হোম অফিসের ভুলের মাসুল দিতে হচ্ছে সাইফুলকে
দেশে ফেরৎ পাঠানোর চেষ্টায় হোম অফিস
সাইফুল ইসলাম, ৪৪ বছরের এই বাংলাদেশী প্রায় ১৬ বছর আগে একজন শেফ হিসেবে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিলেতে পাড়ি জমান। একজন বৈধ কর্মচারী হয়ে রেষ্টুরেন্টে কাজ করলেও তিনি কখনও ন্যায় অধিকার পাননি। বরং তার উপর চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। যেখানে তাকে প্রায়ই দৈনিক ১৮ ঘন্টার বেশী কাজ করতে হতো। এমনকি তিনি সপ্তাহের বেতনটি ঠিক মতো পেতেন না। তিনি বাধ্য হয়ে ২০০৫ সালে পুলিশ এবং হোম অফিসকে তার এই বিষয়টি জানান। এর ফলশ্রুতিতে হোম অফিস সাইফুলকে অন্য জায়গায় কাজ করার অনুমতি দিলেও বাস্তবে এটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। হঠাৎ তাকে যৌন নির্যাতন মামলার আসামী হিসেবে তার ভিসা বাতিল করে ব্রিটেন থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেয়া হয়। আর এতে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে সাইফুল ইসলামের। যিনি একজন কর্মচারী হিসেবে নির্যাতনের শিকার, তাকে উল্টো যৌন নিপীড়ক বানিয়ে দেয়া হলো যার কোন প্রমাণই ছিল না।
সেই লেবার পার্টির টনিব্লেয়ারের শাসনামল থেকে বর্তমান বরিস জনসনের শাসনামল পর্যন্ত ১৮টি কোর্ট আর অসংখ্য ফাইল নিয়ে দিনরাত কাটিয়েছেন সাইফুল ইসলাম শুধু নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য। আদালত কিংবা হোম অফিস সবসময় তাকে দোষী সাব্যস্ত করতেই ব্যস্ত ছিল। যদিও তাদের কাছে সঠিক কোন প্রমাণ ছিলনা। তিনি ব্রিটেনে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করেছেন এটি প্রমাণের জন্য হোম অফিস তার পাসপোর্টের সংশ্লিষ্ট তথ্য আদালতে পেশ করেনি। কিন্তু ২০০৩ সালে বৈধ ভিসা নিয়ে একজন শেফ হিসেবে সাইফুল ব্রিটেনে আসেন। শুধু তাই নয় তার ফাইলের কিছু অংশ হোম অফিস ধ্বংস করে ফেলে।
এক আদালত থেকে অন্য আদালতে ঘুরতে ঘুরতে অসহায় সাইফুল ২০১৮ সালে হোম অফিসের মাধ্যমে জানতে পারেন যে, তাকে ভুলবশত: যোৗন নিপীড়নের তালিকাভূক্ত করা হয়। আর সাইফুল এই ভুলের জন্য বছরের পর বছর কষ্ট করেছেন যা তাকে হতভম্ব করে ফেলে। তিনি জীবনে কোন অপরাধ করেননি আর তাকে সেইসবের দায়ভার নিয়ে চলতে হয়েছে।
২০১৯ সালে হোম অফিস ক্ষমা চেয়ে সাইফুলের নিকট একটি ইমেইল বার্তা পাঠায়। কিন্তু ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর হোম অফিস সাইফুলের ব্রিটেনে থাকা বাতিল করে এবং তাদের ভুলের জন্য তাকে মাত্র ৫০০০ (পাচঁ হাজার) পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দেয়। যাতে তিনি দেশে ফেরৎ চলে যান।
সাইফুল ইসলাম হোম অফিসের এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, আমাকে বিভিন্ন মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে আমার জীবনকে শেষ করে দিয়েছে হোম অফিস। তারা আমার সাথে অমানবিক আচরণ করেছে। যা এদেশে কুকুরের সাথেও করা হয়না। আমি আমার জীবনের মূল্যবান এতটি বছর, সুস্বাস্থ্য হারিয়েছি যা আমি কখনো ফিরে পাবনা। কিন্তু আমি আমার ন্যায্য অধিকারের লড়াই চালিয়ে যাবো।
ব্রাইগ্রেন্ট রাইটস নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিজা কোরেশী বলেন, অসহায় সাইফুল ইসলাম জীবনের এতটি বছর যদি ব্যয় না করতেন, তাহলে তিনি কখনোই আসল সত্যটি জানতে পারতেন না যে তিনি নির্দোষ। হোম অফিস ভূলবশত: সাইফুলের ফাইল অন্যদের সাথে মিলিয়ে তাকে একজন যৌন নিপীড়ক হিসেবে আসামীর তালিকাভুক্ত করে। যার জন্য হোম অফিস ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পর হোম অফিস নির্দোষ সাইফুলকে তারা দেশে ফেরৎ যাওয়ার জন্য বলছে। আমরা হোম অফিসকে অনুরোধ করেছি, নির্দোষ সাইফুলকে যেন ব্রিটেনে থাকার অনুমতি প্রদান করে একজন দক্ষ শেফ হিসেবে তার জীবনের বাকি দিনটুকু সুন্দরভাবে কাটানোর ব্যবস্থা যেন নেয়া হয়। কিন্তু হোম অফিস সাইফুল ইসলামের এই বিষয়টি নিয়ে কোন মন্তব্য করেনি যেহেতু এটি এখনো প্রক্রিয়াধীন।
হোম অফিসের ভুলের জন্য সাইফুল একজন অপরাধীর তকমা গায়ে লাগিয়ে বছরের পর বছর নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। শুধু তাই নয় এর আগে তিনি রেষ্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ৫০০০ (পাচঁ হাজার) পাউন্ড এবং পুরষ্কার হিসেবে তার নিজ দেশে ফেরৎ যাবার আদেশ। যদি এসব কিছু না ঘটতো, আজ সাইফুল ইসলাম অন্য সবার মতো বিলেতে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে পরিবার নিয়ে হয়তো এই সমাজে বসবাস করতেন।
উল্লেখ্য, সাইফুল ইসলামের মতো এরকম আরো অনেকে এই বিলেতে আছেন যারা অন্যের ভুল বা চক্রান্তের শিকার হয়ে এই মনুষ্য সমাজে একজন মানুষ হিসেবে বসবাস করার অধিকারটুকু হারিয়ে অন্ধকার জগতে ঢুকরে ঢুকরে কাঁদছেন। কিন্তু যে বিলেতে একটি পশুও তার অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে, সেই বিলেতে নির্দোষ সাইফুলেরা যেন মানুষ হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকার ন্যায্য অধিকার অর্জন করে। -এমএফএ জামান, তথ্যসূত্র: গার্ডিয়ান ডট কম