আল্লামা তাফাজ্জুল হক হবিগঞ্জী আর নেই
বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহ-সভাপতি, জামেয়া আরাবিয়া উমেদনগর টাইটেল মাদ্রাসা হবিগঞ্জের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদীস এবং সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জামেয়া তোয়াক্কুলিয়া রেঙ্গার শায়খুল হাদীস আল্লামা হাফেজ তাফাজ্জুল হক মুহাদ্দিসে হবিগঞ্জী ইন্তেকাল করেছেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তিনি আজ রোববার (০৫ জানুয়ারী) বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টায় হবিগঞ্জ থেকে সিলেট হাসপাতালে আসার পথে মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮৫ বছর। তিনি ৫ ছেলে ও ৪ মেয়ে সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান। হবিগঞ্জ জামেয়া ইসলামিয়া আরাবিয়া টাইটেল মাদরাসা, হবিগঞ্জ তেতৈয়া মাদানীনগর মহিলা টাইটেল মাদ্রাসা, নুরুল হেরা জামে মসজিদসহ বহু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা বরেণ্য এ আলেমের মৃত্যুর সংবাদ চারদিকে ছড়িয়ে পড়তেই সারাদেশে আলেম-উলামা, ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও ছাত্র-শিক্ষকসহ ভক্তদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
আল্লামা তাফাজ্জুল হকের জীবনী সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৪৪ সালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার কাটাখালি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মাওলানা আব্দুন নুর ছিলেন বড় মাপের আলেম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। লেখাপড়ার শুরুটা বাবার হাত ধরেই। তারপর রায়ধর মাদরাসা। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা তিনি গ্রহণ করেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদরাসায়। বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলেম চট্টগ্রাম হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালক শায়খুল হাদীস আল্লামা আহমদ শফি আল্লামা তাফাজ্জুল হকের শিক্ষক।
চট্টগ্রাম থেকে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান পাকিস্তানে। পাকিস্তানের লাহোর জামেয়া আশরাফিয়া মাদরাসায় তিনি লেখাপড়া করেন। সেখানকার তার উস্তাদ শায়খুল হাদিস আল্লামা রসুল খান ছিলেন পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আলেমে দ্বীন। লাহোর থেকে জ্ঞান আহরনের উদ্দেশ্যে আল্লামা তাফাজ্জুল হক চলে যান ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসায়। সেখানে তিনি উস্তাদ শায়খুল হাদিস ফখরুদ্দিনের (র) সান্নিধ্য লাভ করেন। আল্লামা ফখরুদ্দিন (র) ছিলেন একাধারে পীর ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা। ভারত, পাকিস্তানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জ্ঞান আহরণের পর তিনি চলে আসেন বাংলাদেশে। শিক্ষকতার পেশা দিয়ে তার জ্ঞান বিতরণ কার্যক্রম শুরু।
রায়ধর মাদরাসার মুহাদ্দিস হিসাবে তিনি প্রথম শিক্ষকতার পেশা শুরু করেন। একবছর তিনি সেখানে ছিলেন। পরে চলে যান কুমিল্লার বরুরায়। সেখানেও তিনি শিক্ষকতা করেন। ময়মনসিংহের জামেয়া আশরাফুল উলুম মাদরাসাসহ ময়মনসিংহ জেলায় তিনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।
স্বাধীনতার পর পর তার উস্তাদরা তাকে পাঠিয়ে দেন নিজ জেলা হবিগঞ্জে। প্রথমে তাকে মুহাদ্দিস হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় উমেদনগর মাদরাসায়। ১৯৫৭ সালে শায়খুল হাদিস মিছবাহুজ্জামানের প্রতিষ্ঠিত উমেদনগর মাদরাসায় তখনো দাওরায়ে হাদিস বিভাগ ছিল না। আল্লামা তাফাজ্জুল হক এসে দাওরায়ে হাদিস বিভাগ চালু করেন। এরপর নিরন্তরভাবে হাদিস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন তিনি। ৭১ থেকে ২০২০ সাল। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হাদিস শাস্ত্র পড়িয়ে কয়েক হাজার মুহাদ্দিস তৈরী করেন। যারা এখন দেশ বিদেশে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
শুধুই কি পুরুষরা হাদিস শিক্ষা অর্জন করবে? মহিলারা বাদ যাবে কেন? শুধু এই চিন্তায় তিনি ১৯৯৭ সালে হবিগঞ্জের তেতৈয়া গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মাদানী নগর মহিলা মাদরাসা। এই পর্যন্ত মহিলা মাদরাসা থেকে ২২৫ জনেরও বেশি মহিলা মুহাদ্দিস সনদ নিয়ে বের হয়েছেন। তারা এখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি পরিবারে হাদিস শিক্ষা প্রদান করছেন।
শায়খুল হাদিস তাফাজ্জুল হক বিয়ে করেন বৃহত্তর ময়মনসিংহের বড় হুজুর হিসাবে খ্যাত ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রবক্তা এবং ব্রিটিশদের কালো পতাকা প্রদর্শনকারী মাওলানা আরিফে রাব্বানীর কন্যাকে। তাফাজ্জুল হকের পাঁচ ছেলের সবাই প্রখ্যাত মাওলানা। তাদের মাঝে চারজন কোরআানে হাফেজ। চার কন্যার মধ্যে সবাই টাইটেল পাশ আলেমা। নাতী নাতনীদের প্রায় সবাই কোরআনে হাফেজ ও মাওলানা।