সাবআ মু’আল্লাকার কবি ও কবিতার কথা
আবদুল হালীম খাঁ: ইসলামপূর্ব আরবের সামাজিক ও ধর্মীয় পারিপাশির্^কতা যা ছিল তা সম্পূর্ণ ইসলাম বহির্ভূত এবং এ কারণেই এ যুগকে আইয়ামে জাহেলিয়া রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঐতিহাসিক আল-তাবারী ও মাসুদী এই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তা নাহলে এই যুগে শুধু আরবকে অন্ধকার ও বর্বরতার যুগ বলার কোনো কারণ নেই। সে যুগে শুধু আরব নয়, সারাবিশ্বই ছিল জোর-জুলুম, অন্যায়, অনাচার-অবিচারে ও বর্বরতায় নিমজ্জিত।
আধুনিককালে দেশে দেশে যেমন সাহিত্য সম্মেলন, কবি সম্মেলন, কবিতা পাঠের আসর হয়, তেমনি প্রাচীন আরবদের মধ্যেও কবি সম্মেলন ও কবিতা পাঠের আসর বসতো। বর্তমানে যেমন কবিদের কবিতা নিয়ে সংকলন প্রকাশিত হয়, প্রাচীনকালে আরব কবিদের কবিতা নিয়ে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হতো।
প্রখ্যাত হাতেম তাঈ দানবীর হিসাবে বিশ্ববিখ্যাত। তিনি একজন বিখ্যাত কবি ছিলেন। আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। পঞ্চম শতাব্দীর শেষার্ধ্ব থেকে ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম কয়েক দশক পর্যন্ত ছিল হাতেম তাঈর জীবনের ব্যাপ্তি। তাঁর কাব্যাদর্শ আরবী সাহিত্যে উৎস কেন্দ্রস্বরূপ। তাঁর সময়ই আরবী কবিতার লিখিত রূপের প্রচলন ঘটে। আল বুহতরী সংকলিত ‘দীওয়ানে হামাসা’ গ্রন্থে হাতেম তাঈর বেশ কিছুসংখ্যক কবিতা রয়েছে। তার সেসব কবিতা থেকে তার কাব্য কুশলতার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রায় দুই হাজার বছর আগে রচিত তার কবিতা আধুনিক যুগের মানুষের কাছে সমানভাবে আন্দোললিত। এ জন্যই বলা হয়, কবিতা সকল যুগের সকল কালের। আধুনিককাল বলতে কোনো নির্দিষ্ট কাল নেই। কবি যে যুগের সেটাই তার আধুনিককাল।
কবি সম্মেলন ব্যবস্থাও ছিল প্রাচীন আরবদের সাহিত্য বা কাব্যপ্রীতির লক্ষণ। কবি সম্মেলন হতো উকাজের মেলাকে কেন্দ্র করে। প্রতি বছর এই মেলায় কবিরা কবিতা পাঠ করতেন এবং উৎকৃষ্ট কবিতার জন্য কবিদের পুরস্কৃত করা হতো।
উল্লেখ্য যে, উকাজের মেলায় প্রতি বছর যে কবিতা প্রথম স্থান লাভ করতো সেই কবিতা মিশনারীয় মিহি কাপড়ে সোনার হরফে লিখে দেশের সর্বোত্তম উপাসনা-গৃহ পবিত্র কা’বার গায়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো এবং এভাবে সাতটি কবিতা সাত বছরে প্রথম স্থান লাভ করে এবং এই সাতটি কবিতার সংকলনই ‘সাবআ মু’আল্লাকা’, এর অর্থ সাতটি ঝুলন্ত কবিতা। সাবআ মুআল্লাকার রচনাকাল ইসলামপূর্ব যুগে অর্থাৎ ৫০০ খৃস্টাব্দ থেকে ৬০০ খৃস্টাব্দের মধ্যে।
সাবআ মু’আল্লাকা’র প্রথম কবি ইমরুল কায়স। তার কবিতাটি সর্বাধিক উন্নত ও প্রসিদ্ধ। কবিতাটির প্রথম অংশ হলো :
তোমরা দাঁড়াও,
প্রিয়তমা ও তার বাসগৃহের বিরহে একটু কেঁদে নিই।
যে বাসস্থান বালির টিলার চূড়ায় দাখুল ও হাওমাল
তুযিহ ও মাকরাত নামক স্থানে
উত্তর ও দক্ষিণ বায়ু প্রবাহ সত্ত্বেও
যার চিহ্ন মুছে যায়নি।’
সাবআ মুআল্লাকার দ্বিতীয় কবি তরাফারিন আল আবদ। তার কবিতার প্রথম লাইন ছিল এরূপ:
উলইয়া ও সানাদে অবস্থিত
হে আমার প্রিয় গৃহ! সে অতীত হয়ে গেছে
আর তার বিরহ অনেক দীর্ঘ হয়ে গেল।
তৃতীয় কবি জুহাইর বিন আবি সালমা। তার কবিতার প্রথম অংশ:
দাররাজ ও মুতাছাল্লামের কঠিন ভূখন্ডে অবস্থিত এই নীরব ধ্বংসস্তূপই কি আমার প্রিয়তমা উম্মে আওফার স্মৃতি?
চতুর্থ কবি লবিদ রাবিয়াহ। তার কবিতার প্রথম অংশ:
ছাহমাদের পাথুরে অঞ্চলে আমার প্রিয়া খাওলার
উলকি রেখার ন্যায় ঝলমল করছে মনে হয়।
পঞ্চম কবি আমর বিন কুলসুম। তার কবিতার প্রথম অংশ:
আগেকার কবিরা এমন কোনো অপূর্ণতা
রেখে যাননি, যা পূরণ করা বাকি রয়েছে।
তোমাতে অনেক আন্দাজ অনুমানের পর
তুমি তো প্রিয়ার গৃহে সন্ধান সন্ধান পেয়েছ।
ষষ্ঠ কবি আনতারা বিন শাদ্দাত। তার কবিতার প্রথম বাক্য”
তোমাকে নিয়ে আমার সৌন্দর্য পিয়াসী প্রাণ
উচ্ছ্বলিত হলো যখন যৌবন বিগত প্রায়
এবং বার্ধক্য এসে হানা দিল।
সপ্তম কবি হারিস বিন হিলিজাহ। তার কবিতার প্রথম পংক্তি হলো:
মিনার যে গৃহে আমার প্রিয়
কখনো অল্প সময় কখনো দীর্ঘসময়
অবস্থান করতো, তার চলে যাওয়ার ফলে
সব বিরান হয়ে গেছে। মিনার গাওল ও রিজাম
নামক স্থানও এখন সম্পূর্ণ জনবসতি শূন্য।
এই সাতজন কবি ছাড়াও আরো তিন কবি যেমন নাবিগাহ বিন জুবিয়ানী, আল আশা এবং আল কামা আরবী কাব্য জগতে যথেষ্ট খ্যাতিমান ছিলেন। এই তিনজন কবির তিনটি কবিতাও পরে মুআল্লাকায় সংযুক্ত করা হয় এবং তখন এর নাম করা হয় আশরায়ে মুআল্লাকা অর্থাৎ দশটি ঝুলন্ত কবিতা বা কবিতা সংকলন। কিন্তু আরবী সাহিত্যের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সাবআ মু’আল্লাকার খ্যাতিই সর্বাধিক।
প্রাচীন আরবদের বিশ্বাসে কবিরা ছিলেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী। কাজেই কবি হওয়া ছিল সাংঘাতিক সম্মানের ব্যাপার। তাই কবিদের কবিতার আবৃত্তি এবং তার আলোচনা-সমালোচনা হতো সকলের মুখে মুখে। আরব সমাজে তখন কবিতার কাব্যমান মূল্যায়নেরও অনেক সুধীজন ছিলেন। তারা কবিদের কবিতা নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করতেন।
আরবদের নিয়ম ছিল যে, তাদের কেউ কোনো কবিতা রচনা করলে সে তা কুরায়শদের নিকট পেশ করতো। কুরায়শদের অনুমোদন পেলে তাকে সম্মানিত করা হতো।
এই নিয়মেই অকাজের মেলায় পঠিত কবিতার মান নির্ণয় করা হতো। এসব ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায়, প্রাচীন আরবে প্রচুর কবি ছিলেন, সমাজে তাদের মর্যাদার আসন ছিল, তাদের কবিতার পাঠক ছিল, কবিতার মান নির্ণয়ের উপযোগী সমযদার সুধীজন ছিল, যারা কবিদের পুরস্কারও দিতেন। এদিক দিয়ে প্রাচীন আরব ছিল অনেক অগ্রসর।