করোনাভাইরাসে চীনের বাইরে প্রথম মৃত্যু ফিলিপাইনে
পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে চীন
মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন শতাধিক, আক্রান্ত ২০ হাজার, বিশ্বজুড়ে ফ্লাইট বন্ধের হিড়িক, চীনা নাগরিকদের ওপর ৬৩ দেশের বিধিনিষেধ আরোপ
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালিসহ বিশ্বের অনেক দেশ এরই মধ্যে চীনের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটিতে যেতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নভেল করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত চীনে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৪ জন। এছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজারের উপরে গিয়ে ঠেকেছে। চীনের বাইরে অন্তত ২৪টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। এ অবস্থায় কার্যত পুরো বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্নের পথে দেশটি।
করোনাভাইরাসে চীনের বাইরে ফিলিপাইনে মারা গেছেন ৪৪ বছর বয়সী এক চীনা নাগরিক। তিনি চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে ফিলিপাইনে গিয়েছিলেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ফিলিপাইনে যাওয়ার আগেই ওই ব্যক্তি সংক্রমিত হয়েছিলেন। ফিলিপাইনের স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে, উহান থেকে রাজধানী ম্যানিলাতে যাওয়ার পর ওই চীনা নাগরিকের মারাত্মক নিউমোনিয়া দেখা দেয়। তাকে ভর্তি করানো হয় সেখানকার একটি হাসপাতালে। তার সঙ্গে ফিলিপাইনে গিয়েছেন এক চীনা নারী। তার দেহেও এই ভাইরাসের উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়েছে। ফিলিপাইনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি রবীন্দ্র আবিয়াসিঙ্গে বলেন, চীনের বাইরে এই ভাইরাসে মৃত্যু এটাই প্রথম। আক্রান্ত ব্যক্তি করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহান থেকে গিয়েছিলেন ফিলিপাইনে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের পর সম্প্রতি যেসব দেশ চীনে ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের নিয়ে শুক্রবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম। কানাডাভিত্তিক এয়ারলাইন্স সংস্থা ‘এয়ার কানাডা’ শুক্রবার জানিয়েছে, তারা চীনগামী সব ফ্লাইট বাতিল করেছে। ফ্রান্সভিত্তিক এয়ারলাইন্স সংস্থা ‘এয়ার ফ্রান্স’ও শুক্রবার জানিয়েছে, চীনের মূল ভূখন্ডগামী এবং ফেরত আসা সব ধরনের ফ্লাইট আগামী ৯ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত বাতিল করা হয়েছে। ৩১ জানুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত মুম্বাই-দিলিস্ন-সাংহাইগামী সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ভারতের বিমান সংস্থা ‘এয়ার ইনডিয়া’। দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক এয়ারলাইন্স এয়ার সিউল জানিয়েছে, তারা চীনগামী সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করেছে।
তানজানিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা জানিয়েছে, তারা চীনগামী মূল ফ্লাইটগুলো বাতিল করবে। এছাড়া ফেব্রম্নয়ারিতে চার্টার ফ্লাইট পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। ৯ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত লস অ্যাঞ্জেলেস-বেইজিং/সাংহাইগামী ফ্লাইট স্থগিত করার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক মাসের জন্য চীনগামী সব ধরনের ফ্লাইট বাতিল করেছে ‘ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ’। ৩০ জানুয়ারি থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত চীনগামী ফ্লাইট সংখ্যা অর্ধেক বা তারও বেশি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে হংকংয়ের ‘ক্যাথাই প্যাসিফিক’।
গত ৬ ফেব্রম্নয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চীনগামী ফ্লাইট সংখ্যা প্রতি সপ্তাহে ৪২ থেকে ২১টিতে নামিয়ে আনার কথা জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডেল্টা এয়ারলাইন্স’। ফেব্রম্নয়ারির ১ তারিখ থেকে চীনগামী ও চীন ফেরত সব ধরনের ফ্লাইট স্থগিত ঘোষণা করেছে ‘ইজিপ্ট এয়ার’। নানজিং ও বেইজিংগামী সব ধরনের ফ্লাইট মার্চের শেষ পর্যন্ত স্থগিত করেছে ফিনল্যান্ডভিত্তিক ‘ফিনএয়ার’।
আরও যেসব দেশ ও বিমান সংস্থা চীনগামী ফ্লাইট স্থগিত ও বাতিল করেছে, সেগুলো হলো-ইন্দোনেশিয়ার ‘লায়ন এয়ার গ্রম্নপ’, জার্মানির ‘লুফথানসা’, সুইডেনভিত্তিক ‘সাস’, তুরস্কের ‘টার্কিশ এয়ারলাইন্স’, শিকাগোভিত্তিক ‘ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স’, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘ভার্জিন আটলান্টিক’। এগুলোর বেশিরভাগই ফেব্রম্নয়ারির শুরু থেকে মার্চের শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট স্থগিত ও বাতিল কার্যকরের কথা বলেছে।
চীনা নাগরিকদের ওপর ৬২ দেশের বিধিনিষেধ
এদিকে, চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছেই। ভাইরাসটির বিস্তার ও সংক্রমণ ঠেকাতে বিশ্বের অন্তত ৬২টি দেশ চীনা নাগরিকদের ওপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এরই মধ্যে অন্তত ৬০টি দেশ চীনা নাগরিকদের ভিসা দেওয়ার প্রদানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এছাড়া চারটি দেশ চীনা নাগরিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং চীনের উহান কিংবা ওই প্রদেশে সম্প্রতি ভ্রমণ করেছেন এমন যে কারো বিরুদ্ধে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পাঁচটি দেশ। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও বিস্তার ঠেকাতে ৪৭টি দেশ চীনা নাগরিকদের দেশে প্রবেশের আগেই বিমানবন্দরে তাপমাত্রা পরিমাপ করা থেকে শুরু করে নানা রকম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
এছাড়া সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঘোষণা দিয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে সিঙ্গাপুরে বসবাস করছেন বা যারা সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা, তারা বাদে কোনো চীনা পাসপোর্টধারীকে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। তবে যেসব চীনা পাসপোর্টধারী দেখাতে পারবেন, তারা সম্প্রতি চীনে যাননি, তাহলে ‘কেস-বাই-কেস’ বিবেচনায় তাদের সিঙ্গাপুরে প্রবেশে অনুমতি দেওয়া হতে পারে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, যারা এই মুহূর্তে দেশের বাইরে যেতে চাইছেন, তাদেরকে নিজ নিজ স্বাস্থ্যের অবস্থার ভিত্তিতে ভ্রমণের আয়োজন করতে হবে।