এক বিলিয়ন ডলার টেলিকম খাতে বিনিয়োগ করবে সউদী
বাংলাদেশে ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সউদী আরব
উভয় দেশের মধ্যে ৬০টি ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এরমধ্যে ৩০টি বিষয়ে চুক্তিসই হয়েছে
গ্রাম পর্যায়ে ফোরজি টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং শহরে ফাইভজি সেবা প্রদানে ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে কিংডম অব সউদী আরব (কেএসএ)। সউদী বিনিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়াত্ত মোবাইল সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান টেলিটক বাংলাদেশ লিমিটেডের (টিবিএল) অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। সউদীর টেলিকম খাতে বিনিয়োগ করা বড় প্রতিষ্ঠান আল-জমিয়াহ গ্রুপ টিবিএল এই বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতি ডলার সমান ৮৫ টাকা ধরে বাংলাদেশী মুদ্রায় টেলিকম খাতে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে সউদী আরব। এছাড়াও যেসব খাতে সউদী আরব বিনিয়োগ করতে চায় সেগুলোর মধ্যে আছে- জনশক্তি ও কর্মসংস্থান, দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিনিয়োগ ও শিল্প, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিখাতসহ ধর্ম বিষয়ক খাত। প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে সউদী আরব।
আজ বুহষ্পতিবার বাংলাদেশ-সউদী আরব যৌথ কমিশনের (জেসি) ১৩তম সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। দুই দিনব্যাপী জেসি সভা অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর শেরে বাংলানগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মনোয়ার আহমেদ এবং সউদী আরবের প্রতিনিধিদলের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সউদী শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মাহির আব্দুল রাহমান গাসিম।
উভয় পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে এক হাজার একর জমি বরাদ্দ দেবে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বা বেজা। সউদীর আল বাওয়ানি গ্রুপ এখানে বিশাল বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করবে। এর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের ফার্নিচার খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং রফতানির জন্য বিনিয়োগ করবে সউদী আরব। এই বিষয়ে সউদী আরব ও বাংলাদেশ সরকার একমত পোষণ করেছে। এই বিষয়ে সউদী আরবের ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন ও বাংলাদেশের বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফআইডিসি) এক সঙ্গে কাজ করবে।
ইআরডি সূত্র জানায়, সউদী আরবের শ্রমশক্তির ১৩ শতাংশই বাংলাদেশি। তারা সউদী আরবের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন বলে জানান দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী মাহির আব্দুল রাহমান গাসিম। দুই দিনের বৈঠকে সউদী আরব জানিয়েছে আরো দক্ষ জনশক্তি নেবে। শ্রমশক্তি নেয়ার বিষয়ে এই ধারা চলমান থাকবে। শ্রম মন্ত্রণালয় ও সউদী আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল কমিটি এই বিষয়ে আরো বৈঠক করবে। কোন কোন খাতে দক্ষ জনশক্ত পাঠানো যা বছরে কি পরিমাণ জনশক্তি পাঠানো যা তা নির্ধারণ করবে উভয় দেশের টেকনিক্যাল কমিটি। এছাড়া সউদীর পক্ষ জনশক্তি সম্পর্কিত বিষয়গুলি সম্পর্কে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এক সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দক্ষ জনশক্তিসহ অন্যান্য খাতে সউদী আরবে লোক পাঠাতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ। সউদী আরবে বাংলাদেশী মেডিকেল কর্মীদের নিয়োগের বিষয়ে উভয় দেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ থেকে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও মিডওয়াইফ নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য একটি কার্যনির্বাহী কর্মসূচী প্রস্তুত করতে সম্মত হয়েছে উভয় দেশ। এই কমিটি ঠিক করবে কি পরিমাণে স্বাস্থ্যকর্মী সউদী আরবে পাঠানো যাবে। একই সঙ্গে বছরে কি পরিমাণে স্বাস্থ্যকর্মী সউদী আরবে পাঠানো হবে। তাদের বেতন কেমন হবে, সবই ঠিক করবে কমিটি। যে কমিটির যাত্রা শুরু হয় এই বৈঠকে।
ইআরডি সচিব মনোয়ার আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, উভয় দেশের মধ্যে ৬০টি ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এরমধ্যে ৩০টা বিষয়ে চুক্তিসই হয়েছে। সউদী আরব বাংলাদেশের অধিকাংশ খাত নিয়েই আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এক বিলিয়ন ডলার টেলিকম খাতে বিনিয়োগ করবে।
শ্রমশক্তির বিষয়ে ইআরডি সচিব বলেন, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। এখন সউদী আরব বাংলাদেশ থেকে আরো মেডিকেল কর্মী নিতে চায়। কিভাবে মেডিকেল কর্মী পাঠানো হবে উভয় দেশের টেকনিক্যাল কমিটি ঠিক করবে। ইআরডি সূত্র জানায়, সউদীর এ্যাকোয়া পাওয়ারের সঙ্গে ১৮০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য চুক্তি হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই সউদী আরবের বেসরকারি বিনিয়োগকারিরা বাংলাদেশে আসবেন এবং এমওইউ স্বাক্ষরিত হবে। বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে উভয় পক্ষই এক সঙ্গে কাজ করবে।
উভয় পক্ষ ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ও মতবিনিময় কর্মসূচির জন্য বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমি (বিএফএসএ) এবং প্রিন্স সউদ আল ফয়সাল ইনস্টিটিউশন ফর ডিপ্লোমেটিক স্টাডিজ (পিএসএফআইডিএস) এর মধ্যে সমঝোতা চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করেছে। প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করতে সম্মত হয়েছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এ বৈঠকের আয়োজন করে। দু’দিনের যৌথ কমিশন বৈঠকে উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা এজেন্সিগুলির উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন। মৈত্রী এবং পারস্পরিক দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের মূল বিষয়টিকে ধরে রেখে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উভয় প্রতিনিধি দল দু’দেশের সর্বশেষ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির তথ্য আদান-প্রদান করে। এ সময় বাংলাদেশ ও সউদী আরবের মধ্যে সহযোগিতার ফলাফল পর্যালোচনা করে। উভয় পক্ষই বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও জোরদার করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। যেসব বিষয়ে সহযোগিতা করতে উভয় দেশ সম্মত হয়েছে সেগুলো আলোচনা হচ্ছে, বিদেশ, অভ্যন্তরীণ ও বিচার বিভাগীয় সহযোগিতার ক্ষেত্রে উভয় পক্ষই পাসপোর্ট, ওয়ার্কিং ভিসা এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক ভ্রমণের নথি জারি করার বিষয়ে আরও ঘনিষ্টভাবে কাজ করবে।
এছাড়া উভয় পক্ষ স্ব স্ব দেশের মধ্যে বিচারিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে কাজ করার জন্য আরও সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। দু’দেশেই মাদক নিয়ন্ত্রণ, জালিয়াতি এবং জালিয়াতির অপরাধের ক্ষেত্রে একসঙ্গে কাজ করতে আরও সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে এবং উভয় দেশে শান্তি ও সম্প্রতি বজায় রাখতে নতুন তথ্য হালনাগাদ করবে। বৈঠকে বাংলাদেশী পক্ষ তিনটি ইস্যু সম্পর্কিত একটি প্রস্তাব হস্তান্তর করা হয়। এগুলো হচ্ছে- সউদী বিচার মন্ত্রণালয়ের ওয়েববসাইটে ট্র্যাফিক দুর্ঘটনার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ মামলার অনলাইন জমা দেয়ার বিষয়ে সমস্যা, মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চেক প্রদান সংক্রান্ত সমস্যা এবং ফাঁসির আদালত থেকে নিহতের উত্তরাধিকারীর নাম এবং ফাঁসি আদালতে জমা দেওয়ার মামলা সম্পর্কিত সমস্যা।
এ সময় সউদী পক্ষ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। সউদী আরবের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্রঋণ, বিধিবিধান, বিজ্ঞপ্তি এবং এ বিষয়ে জ্ঞান সম্পর্কে বাংলাদেশিদের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান ভাগ করে নিতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ পক্ষ থেকে সউদী প্রতিনিধি দলকে ক্ষুদ্র ঋণ সম্পর্কিত অভিজ্ঞতার জন্য সরাসরি এমআরএ এবং পিকেএসএফের সঙ্গে সাক্ষাত করার অনুরোধ করা হয়। বৈঠক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ সউদী প্রতিনিধি দলকে নতুন বিনিয়োগের সুযোগ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলির বিশদ তথ্য সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে।
উভয় পক্ষ উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যিক পণ্যের বৈচিত্রায়নের উপর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করেছে। বৈঠকে সউদী পক্ষ সউদী ফান্ড ফর ডেভলপমেন্ট (এসএফডি) এবং বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সহযোগিতা জোরদরের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষ সউদী রফতানি কর্মসূচির (এসইপি) বাংলাদেশী ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের উপকারভোগীদের অর্থায়নের সুবিধার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেছেন। এ বিষয়ে যৌথ অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়। সউদী চেম্বারের কাউন্সিলের অধীনে সউদী বিনিয়োগকারী সংস্থাগুলি (এসিডব্লিউএ) পাওয়ার, আরামকো, আল-বাওয়ানী, আল জোমিয়া, ইঞ্জিনিয়ারিং ডাইমেনশন, রেড সি গেট ওয়ে টার্মিনাল, মধু ও স্বাস্থ্য) বাংলাদেশে সউদী বিনিয়োগ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছে। উভয় পক্ষই মূল দেশ, পণ্যাদি প্যাকেজিং, প্যাকেজ সম্পর্কিত তথ্য সরবরাহ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়াদিসহ উভয় দেশের শুল্ক কর্তৃপক্ষের নিয়মকানুন মেনে চলতে সম্মত হয়েছে। দু’দেশের পর্যটন সম্পর্কিত সম্মেলন এবং অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পর্যটন বিশেষজ্ঞ, পেশাদার, ট্যুর অপারেটর এবং ভ্রমণ লেখকদের বিনিময়ে বাংলাদেশকে আরো সহযোগিতা করবে বলে জানায় সউদী আরব।