দাড়ি, টুপি ও বোরকার জন্য মুসলিমদের বন্দি
চীনে মুসলিমদের বন্দি রাখার গোপন নথি ফাঁস
চীনের উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘু লোকজনসহ বেইজিংয়ের গণ আন্দোলনের ন্যায্যতা দাবি করা অনেক নাগরিকদের বন্দি করে রাখার একটি গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির দ্বারা বিদ্রোহীদের দমন প্রক্রিয়ার এমন গোপন নথিটির খবর প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন। ১৩৭ পৃষ্ঠার দলিলে প্রতিটি পৃষ্ঠায় ভিন্ন ভিন্ন কলাম এবং ছক কেটে ঐ মানুষেরা কতবার নামাজ পড়েন, কী পোশাক পরেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের আচার আচরণের বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
গণমাধ্যমটিতে বলা হয়, চীনের সংখ্যালঘু উইঘুরে মুসলিম সম্প্রদায়ের কেবল একটি পরিবার নয়, শতশত পরিবার কিংবা দেশটির লক্ষ লক্ষ নাগরিককে তুচ্ছ কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য গোপনে আটকে রাখা হতো। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির এমন নিয়ম প্রথমবারের মত প্রকাশ করেছে দেশটির কিছু উইঘুরের সোচ্চাররা। এটা ছিল তৃতীয়বারের মত চীনা সরকারের স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁসের খবর।
দেশপ্রেমহীনতা হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিম উইঘুরে সম্প্রদায়কে তাদের ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক মৌলবোধ থেকে বিচ্যুত করতে চীনা সরকারের একটি ভয়ংকর কৌশল উঠে এসেছে এ নথিতে। দাড়ি রাখা, বোরকা পরা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য চীনের উইঘুর মুসলিমদের অনেককে বন্দি করা হয়েছে। তবে চীন সরকার দাবি, চলমান চরমপন্থিদের গণবিচ্যুতকরণের জন্য এটি একটি প্রক্রিয়া। যেটি কিনা একটি বিশেষজ্ঞ টিমদ্বারা পরিচালিত হয়। এ নথিতে দেখানো লোকগুলোকে কেবল ওড়না পড়া ও দীর্ঘ দড়ি বাড়ানোর জন্য আটক করা হয়।
রোজিন্না মমতোহট্টি নামের এক মুসলিম নারী সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চীনা সরকারের এ নথির বিস্তারিত দেখার পরে বেশ কিছু দিন তিনি কিছু খেতে ও ঘুমাতে পারেনি। কারণ সে দেখেছে যে তার পরিবার চীনা সরকারের নজরদারিতে বন্দি রয়েছে। কিন্তু সে এবং তার পরম আত্মীয়রা চীনের জিনজিয়াংয়ের পশ্চিমাঞ্চলে থাকতেন। তারা কোন রকম পরিচিত মুখ কিংবা চরমপন্থিও ছিল না।
উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকেদের মাধ্যমে তার পরিবারের রেকর্ড এবং তাদের মতো শত শত সরকারি রেকর্ড প্রকাশ করেছে ওই গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা।ফাঁস হওয়া নথি থেকে জানা যায়, সরকারি স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছে তাদের পুরো পরিবারের কাজকর্ম, ধর্মীয় রীতিনীতি, বিশ্বস্ততা ও কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতার মাত্রাও উল্লেখ রয়েছে। এই নথি থেকে নির্ধারণ করা যায়, কোনও সরকারি বন্দিসেলে রেজার তারের মধ্যে কেউ আটক আছে কিনা।
মমতোহট্টি জানায়, ৩৪ বছর বয়সী তার বোন পতেমকে পরিবার পরিকল্পনা নীতি লঙ্ঘনের জন্য আটক রাখা হয়েছিল। কারণ জিনজিয়াংয়ের গ্রামাঞ্চলে একজন তিনটি সন্তানের বেশি নিতে পারবে না। কিন্তু পতেম এর ছিল চারটি সন্তান। কিন্তু ২০১৬ পর থেকে এটা ছিল প্রথম সত্য খবর । যে তার পরিবারের সাথে আসলেই কী ঘটেছিল।
সে সিএনএন কে বলেছেন, আমি কল্পনা করতে পারি না আমার ছোট বোন জেলে থাকতে পারে। সে বলেছে , আমি যখন ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে তাদের নাম পড়ছিলাম আমি মেনে নিতে পারছিলাম না। আমি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ছিলাম।
গণমাধ্যমটিতে বলা হয়, আপাতদৃষ্টিতে ফাঁস হওয়া নথিগুলোকে চীনের স্থানীয় সরকার দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রীয় নজরদারির বিস্তারিত ও সুদূর প্রসারী ব্যবস্থা বলে মনে হবে। যা চীনা নাগরিকদের তাদের সংস্কৃতি ও ধর্মকে শান্তিপূর্ণভাবে পালনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। ফাঁস হওয়া নথি নিয়ে সিএনএন বলছে, তারা নথিতে থাকা কেবলমাত্র কয়েকটি তথ্য স্বাধীনভাবে যাচাই করতে সক্ষম হয়েছে।
ওয়াশিংটনের ডিসি-র ভিকটিমস অফ কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের প্রবীণ সহযোগী চীনের অ্যাড্রিয়ান জেনজের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদের একটি দল বলছে , তারা নিশ্চিত যে এটি চীনের একটি খাঁটি সরকারি দলিল। এতে উইঘুর নাগরিকদের এমন কাজের জন্য আটক করা হয়েছে যা তেমন কোন অপরাধের মত নয়।
জেনজ সিএনএনকে বলেন, ফাঁস হওয়া তথ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কারণ এটি সরকারের এমন একটি হীন মানসিকতাকে দেখায় যা এই পৃথিবীর উপর আসন্ন সুপার পাওয়ারকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে সিএনএন নথিটির একটি অনুলিপি জিনজিয়াংয়ের চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকার উভয়কে পাঠিয়েছিল এবং এর সত্যতা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু এতে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া ছিল না।