যুদ্ধে বিপর্যস্ত শিশুরা ঠাণ্ডায় জমে মরছে
সিরিয়ার নতুন বাস্তুচ্যুতদের ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। সবচেয়ে বেশি পীড়াও তাদেরই সহ্য করতে হয়। জাতিসংঘের মানবিক বিষয় ও জরুরি ত্রাণ বিষয়ক প্রধান মার্ক লোকক বলেন, সিরিয়ার পরিস্থিতি ভয়াবহতার নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। সোমবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, বাস্তুচ্যুতরা ‘আতঙ্কিত’। শিবিরগুলোয় জায়গা নেই। জমে যাওয়ার মতো তাপমাত্রায় তাদের বাইরে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে। মায়েরা প্লাস্টিক পুড়িয়ে শিশুদের উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছেন। ঠাণ্ডায় নবজাতক ও ছোত শিশুরা মারা যাচ্ছে।
কয়েকদিন আগে সিরিয়া-তুরস্ক সীমান্তের নিকটে কালবিত শিবিরে আরিজ মজিদ আল-হমেইদি নামের পাঁচ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিবিরের এক কর্মকর্তা আবু আনোয়ার জানান, শিশুটির পরিবার গণমাধ্যমের সামনে আসতে চায় না। শিশুটির মৃত্যুর জন্য তারা নিজেদের দায়ী করছে। তাকে পর্যাপ্ত উষ্ণ রাখতে না পারায় নিজেদের দোষ দিচ্ছে। আনোয়ার আরো বলেন, এখানকার পরিস্থিতি অসহনীয়। এখানে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ মানুষের ৮০০ পরিবার আছে। অথচ, শিবিরটিতে পানি সরবরাহ করছে মাত্র একটি সংগঠন।
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিরিয়ায় কাজ করা গবেষক সারা কায়ালি বলেন, দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নজিরবিহীন মানবিক সংকট চলছে। একটি বিষয় হচ্ছে, বাস্তুচ্যুতের মাত্রা মানবাধিকার কর্মীদের সামাল দেয়ার সক্ষমতার চেয়ে বহুগুণ বেশি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সহিংসতা- গোলাবর্ষণ, বিমান হামলায় কেবল মানুষ ঘরছাড়াই হচ্ছেন না, তাদের আশ্রয় ও খাদ্য প্রদানের সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ইদলিবের সারমাদায় এক হাসপাতালে কাজ করেন ইউনিয়ন অব মেডিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড রিলিফ অর্গানাইজেশন (ইউওএসএসএম)-এর সদস্য মায়দা কাবালাম। তিনি বলেন, এখানে বাস্তুচ্যুতদের অবস্থা ‘সহনসীমা’ ছাড়ানোর পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তা হৃদয়বিদারক। খোলা আকাশের নিচে কোনো আবরণ ছাড়া বাস করছে মানুষ। তিনি আরো বলেন, একটি তাঁবুর দাম ১৫০ ডলার। মানবাধিকার সংগঠনগুলো জোগান ও লোকবলের ঘাটতিতে ভুগছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর নতুন বাস্তুচ্যুতদের সহায়তা করার সক্ষমতা নেই।
কায়ালি বলেন, এসব ঘটনা একেবারে নতুন নয়। কিন্তু এ নিয়ে এরকম অকাট্য নীরবতা ও পদক্ষেপের অভাব হতবাক করার মতো। অনেকটা এমন যে, মানুষ কেবল দেখছে ও অপেক্ষা করছে কখন তারা ফাঁদে আটকা এই লাখো বেসামরিকদের রক্ষার অভিনয় করতে পারবে।
উল্লেখ্য, রুশ বিমান বাহিনীর সমর্থন নিয়ে সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনারা গত এপ্রিল থেকে ইদলিবে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তীব্র হামলা অভিযান শুরু করে। প্রদেশটিতে বসবাস প্রায় ৩০ লাখ মানুষের। এদের অনেকে সরকারি বাহিনীর দখলে থাকা বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে গিয়ে জড়ো হয়েছেন। বিদ্রোহীদের সামরিক বাহিনীর এই ধাক্কা সিরিয়ার প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতায় ফাটল ধরিয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এক চুক্তি অনুসারে, ইদলিবকে ‘ডি-এস্কালেশন জোন’ বা যুদ্ধ-মুক্ত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হলেও গত ডিসেম্বর থেকে সেখানে সামরিক অভিযান নতুন উদ্যোমে শুরু করেছে সরকার। প্রদেশটির মধ্যে দিয়ে চলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক রাস্তা এমফাইভ হাইওয়ে দখলে চেষ্টা জোরদার করে সরকারি জোট। আলেপ্পো প্রদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক পরিবহণ ও যোগাযোগে অন্যতম প্রধান রাস্তা এটি। সরকারের এমন পদক্ষেপে আলেপ্পোর পশ্চিমাংশ থেকে জোরপূর্বক ঘরছাড়া হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছেন ইদলিবে। প্রাণ হারিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে এক দফায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আলেপ্পো ও ইদলিব থেকে। জাতিসংঘ অনুসারে, এ সংখ্যা অন্তত ৯ লাখ। উপরন্তু, বেসামরিকদের ওপর নির্বিচারে গোলাবর্ষণে খোলা আকাশের নিচে- গাছের নিচে, তুষারে ভরা মাঠে- ঠাঁই গাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৮২ হাজার মানুষ। ঠাণ্ডায় জমে মারা যাওয়ার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে তারা।