এবার আয়ারল্যান্ড নিয়ে মাথাব্যথায় ইংল্যান্ড
আয়ারল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে অবস্থিত একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। সার্বভৌম রাষ্ট্রটি আয়ারল্যান্ড দ্বীপের পাঁচ-ষষ্ঠাংশ নিয়ে গঠিত যা ৩ মে ১৯২১ সালে যুক্তরাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রথমে আইরিশ ফ্রি স্টেট এবং পরে প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড গঠন করে। রাজধানী ডাবলিন যা আয়ারল্যান্ড দ্বীপের সর্ববৃহৎ শহর। এই দ্বীপের একটি অংশ উত্তর আয়ারল্যান্ড যা যুক্তরাজ্যের অংশ।
আয়ারল্যান্ডের সাথে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক দেখতে হলে একটু পেছনে যেতে হবে। আয়ারল্যান্ড দ্বীপজুড়ে ছিল একটি রাজ্য আয়ারল্যান্ড। ১১৯৮ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যটি একক রাজার শাসনে ছিল যাদের বলা হতো হাই কিং অব আয়ারল্যান্ড। গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ইংল্যান্ড পুরো গ্রেট ব্রিটেনকে নিজেদের দখলে রাখতে ওয়েলস, স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড নিজেদের দখলে নেয়।
ইংল্যান্ড রাজত্বের একটি চাপ সবসময়ই আয়ারল্যান্ডের ওপর ছিল। এ কারণেই ১৫৪১ সালে আইরিশ পার্লামেন্ট (রাজত্ব থাকলেও দেশগুলোতে পার্লামেন্ট সক্রিয় ছিল) ক্রাউন অব আয়ারল্যান্ড অ্যাক্ট-১৫৪২ পাসের মধ্য দিয়ে কিংডম অব আয়ারল্যান্ড প্রতিষ্ঠা করে এবং নির্ধারিত হয় যে ইংল্যান্ডের রাজা বা রানীই হবেন, আয়ারল্যান্ডের রাজা বা রানী। এ ক্ষেত্রে শাসক এক হলেও রাজ্য দুটো আলাদাভাবে স্বাধীন এবং স্বতন্ত্র ছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৮০০ সালে রাজা তৃতীয় জর্জের সময় গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্টে অ্যাক্ট অব ইউনিয়ন-১৮০০ পাস করা হয় এবং পরের বছর ১৮০১ সালে দুটো রাজ্যকে এক করে একটি অভিন্ন রাজ্য গঠন করা হয় যার নাম ইউনাইটেড কিংডম অব গ্রেট ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড।
পরে আইরিশরা ব্রিটেন থেকে আলাদা হওয়ার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকে। ১৯১৩ সালে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি (আইআরএ) গঠিত হয়। তারা স্বাধীনতার জন্য ব্যাপক গেরিলা হামলা চালাতে শুরু করে। ১৯১৯ সালে শুরু হওয়া এ যুদ্ধে ১৯২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে আয়ারল্যান্ড স্বাধীনতা অর্জন করে।
আয়ারল্যান্ড স্বাধীন হলেও দ্বীপের একটি অংশ যা উত্তর আয়ারল্যান্ড নামে পরিচিত, সেটি ব্রিটেনের সাথেই থেকে যায়। যা এখনো বিদ্যমান। সদ্য ব্রেক্সিটের ফলে এই দুই অংশ নিয়ে ব্যাপক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ আয়ারল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত। আর উত্তর আয়ারল্যান্ড ইংল্যান্ডের সাথে যুক্ত থাকার ফলে এই দুই দেশের সম্পর্ক কী ধরনের হবে তা নিয়ে ইংল্যান্ড ও ইইউ বেশ বেকায়দায়।
এরই মধ্যে দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে দেখা দিচ্ছে দুই আয়ারল্যান্ডের পুনরায় একত্রীকরণ। দুই আয়ারল্যান্ডের একীকরণের চাপটি এখন ব্রেক্সিটের চেয়ে বেশি হয়ে দেখা দিচ্ছে। উত্তর আয়ারল্যান্ডে আইরিশ জাতীয়তাবাদের ধারণা শক্ত হচ্ছে। তা ছাড়া ধর্মীয় কারণেও দুই আয়ারল্যান্ড একীকরণের সমর্থন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেড়েছে বলে মনে করা হয়।
ইইউ ইতোমধ্যে বলেছে, গণভোটের মাধ্যমে পুনরায় দুই আয়ারল্যান্ড একত্রীকরণ হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, উত্তরের ভোটাররা ব্রেক্সিটের পর আইরিশ ঐক্য নিয়ে দ্বিতীয় গণভোটের আয়োজন করতে পারে। দুই আয়ারল্যান্ডের একত্রীকরণের বড় ধরনের লক্ষণ হলো আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সাথে যুক্ত রাজনৈতিক দল সিন ফেইনের সর্বশেষ নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্য। যা এক দশক বা তার মধ্যে সংযুক্ত আয়ারল্যান্ড গঠনের পথে ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনার সর্বশেষ সাফল্য বলে মনে করা হয়।
তবে, এই একত্রীকরণের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও দেখা দিতে পারে। সিন ফেইনের সাফল্য উত্তর আয়ারল্যান্ডকে একত্রীকরণের ক্ষেত্রে আশাহত করতে পারে। ব্রেক্সিট প্রত্যাশার চেয়ে কম প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, এ জাতীয় গণভোট খারাপ কিছুকে উসকে দেবে এবং সহিংসতা সৃষ্টি করবে।
তবুও বেশির ভাগ লোক মনে করেন, প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুতই আয়ারল্যান্ডের একত্রীকরণের বিষয়টি গতি পাবে আর তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবে। স্কটল্যান্ড যদি স্বাধীনতা বেছে নেয়, উত্তর আয়ারল্যান্ডের অনেকেই ব্রিটেনের সাথে সম্পর্ক ছেদ করবে।
আয়ারল্যান্ড দ্বীপের একটি পরিকল্পনা দরকার। একত্রকারীদের আয়ারল্যান্ড নিয়ে কী চিন্তাভাবনা রয়েছে তা প্রকাশ করা দরকার। দুই অংশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা (যার মধ্যে একটি বিনামূল্যে), সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশি বাহিনী ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের পার্লামেন্ট নিয়ে বিভক্তি সম্পর্কে কী করা যায় তার সমাধান বের করা।
ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিবিদদেরও কথা শুরু করা দরকার। দুই দশক আগে সহিংসতার অবসানের মূল লক্ষ্য ছিল উত্তর আয়ারল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড এবং ব্রিটেন সম্মিলিতভাবে যে চুক্তিতে করে তার লক্ষ্য ছিল সংযুক্ত আয়ারল্যান্ডের সুষ্ঠু রাজনৈতিক পথ নির্ধারণ। উত্তর আয়ারল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মানুষ যদি সেই পথটি বেছে নেয়, রাজনীতিবিদদের অবশ্যই এটি অনুসরণ করতে হবে। দুই অংশের মানুষ কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটিই এখন দেখার বিষয়।