বিবিসির প্রতিবেদন
টাকার মাধ্যমেও ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস
ব্যাংক নোট বা টাকায় নানা ধরনের জীবাণুর উপস্থিতি শনাক্তের ঘটনা নতুন নয়। এমনকি ব্যাংক নোটের মাধ্যমে সংক্রামক নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ার কথাও বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে বিশ্বের অন্তত ৮০টি দেশে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় এ নিয়ে নতুন করে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ ছাড়াও ব্যাংক নোটের মাধ্যমেও করোনাসহ মারাত্মক সব রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে।
বুধবার বিবিসি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে টাকার মাধ্যমে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কা কতটুকু তা বিশ্লেষণ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সালে দিল্লির ইনস্টিটিউট অব জিনোমিকস অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজির বিজ্ঞানীরা জানান, ভারতের বাজারে চালু নোটগুলো পরীক্ষা করে তাতে অন্তত ৭৮ রকম বিপজ্জনক জীবাণুর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা থেকে মারাত্মক সব রোগ ছড়াতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের একদল গবেষক গত বছরের আগস্ট মাসে বলেছিলেন, তারা বাজারে চালু টাকার নোট ও ধাতব মুদ্রায় এমন ধরনের ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পেয়েছেন, যা সাধারণত মলমূত্রের মধ্যে থাকে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের ছাত্রী নিশাত তাসনিম প্রায় ছয় মাস ধরে বাজারে প্রচলিত টাকা ও কয়েন নিয়ে গবেষণা করে বলেন, এসব মুদ্রায় তিনি ই-কোলাই জাতীয় ব্যাকটেরিয়া পেয়েছেন। ১৫টি উৎস থেকে নেওয়া টাকার নোট ও কয়েনে হাজারের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়। অথচ এক হাজার মাত্রা পর্যন্ত ব্যাকটেরিয়াকে সহনশীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী টাকা নিয়ে করা ওই গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমরা গবেষণা করে টাকায় বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া পেয়েছি যা মানুষের অন্ত্রে নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করে। তাই এর মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়াটাও অস্বাভাবিক নয়।’ তার মতে, টাকা বা ডলারের ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক বিনিময়ের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস শুধু একটি দেশের মধ্যে নয়, বরং বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে।
এমন আশঙ্কায় গত মাসে ভাইরাসে উপস্থিতি নিয়ে ব্যাংক নোট জীবাণুমুক্ত করার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল চীন। দেশটিতে সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সেখানে এটির বিস্তার ঠেকাতে বাজার থেকে নোট সরিয়ে নিয়ে তা আবার জীবাণুমুক্ত করে বাজারে ছাড়ে দেশটি।
ড. হারুন বলেন, ‘যেহেতু এটা সরাসরি মানুষ হাত দিয়ে ধরে, অনেক সময় থুতু নিয়ে কাউন্ট করে। তাই এর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। ভাইরাস বাহকের শরীরে সক্রিয় হয়, অন্যত্র নিষ্ক্রিয় থাকে। টাকায় থাকলে সেটি হয়তো নিষ্ক্রিয় থাকে, কিন্তু মানুষের সংস্পর্শে এলে সেটি করোনা ভাইরাসের উপসর্গ বা রোগের সৃষ্টি করতে পারে, এ আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
এমন আশঙ্কায় গত মাসে ভাইরাসে উপস্থিতি নিয়ে ব্যাংক নোট জীবাণুমুক্ত করার একটি উদ্যোগ নিয়েছিল চীন। দেশটিতে সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর সেখানে এটির বিস্তার ঠেকাতে বাজার থেকে নোট সরিয়ে নিয়ে তা আবার জীবাণুমুক্ত করে বাজারে ছাড়ে দেশটি।
মুদ্রার মাধ্যমে কীভাবে সংক্রমণ এড়ানো যাবে, তা নিয়েও বিবিসির প্রতিবেদনে আলোকপাত করা হয়। সেখানে জানানো হয়, বিশ্বজুড়ে এমন আশঙ্কার পর বিশেষজ্ঞরা ব্যাংক নোট এড়িয়ে স্পর্শবিহীন মাধ্যম বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেনাকাটা বা লেনদেনের পরামর্শ দিয়েছেন। স্পর্শবিহীন লেনদেন বা প্রযুক্তি বলতে, ব্যাংক নোট ছাড়া অন্য মাধ্যম যেমন কার্ড, বিভিন্ন ধরনের অ্যাপ যেমন বিকাশ বা নগদ অথবা অন্য কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে লেনদেনের কথা বোঝানো হয়েছে।
টাকা গোনার সময় হাত দিয়ে মুখের লালা নেবেন না। নোট বা টাকা নাড়াচাড়ার পরপরই অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। যারা অত্যধিক মুদ্রা নাড়াচাড়া করেন, যেমন ব্যাংক কর্মী বা মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা, তাদের অবশ্যই অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে
তবে বাংলাদেশের মতো দেশ যেখানে প্রায় শতভাগ লেনদেন হয় নোটের মাধ্যমে, সেখানে কীভাবে এ পরামর্শ বাস্তবায়ন সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের পরামর্শ মেনে চলা কঠিন। তবে নোট ব্যবহারের বিষয়ে তারা বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাবেক পরিচালক মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে যেহেতু এখনো করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি, তাই এখনই এ বিষয়ে বলাটা কঠিন। তবে যদি শনাক্ত হয়, সে ক্ষেত্রে ভাইরাসটি যাতে অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য ব্যাংক নোট ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে।
এ ক্ষেত্রে কিছু পরামর্শের কথা বলছেন মাহমুদুর রহমান অবশ্যই টাকা গোনার সময় হাত দিয়ে মুখের লালা নেবেন না। নোট বা টাকা নাড়াচাড়ার পরপরই অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে হবে। যারা অত্যধিক মুদ্রা নাড়াচাড়া করেন, যেমন ব্যাংক কর্মী বা মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীরা, তাদের অবশ্যই অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। তারা গ্লাভস পরে নিতে পারেন। সতর্কতা হিসেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজারও ব্যবহার করতে পারেন। টাকা ধরা বা ব্যবহারের পরপরই চোখ, নাক বা মুখে হাত দেওয়া যাবে না।