করোনাভাইরাস: ইতালিতে ভয়াবহতার নেপথ্যে
আন্তর্জাতিক জরিপ সংস্থা ওয়ার্ল্ডোমিটার-এর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শুক্রবার পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যর হার গড়ে ৩.৬৯ শতাংশ। তবে ইতালিতে এ হার ৬.৭২। চীনের পর সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের সংখ্যাও ইতালিতে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদন ও বিশেষজ্ঞ মন্তব্য বিশ্লেষণ করে দেশটিতে মৃত্যুর হার এত বেশি হওয়ার পেছনে কয়েকটি সম্ভাব্য কারণ শনাক্ত করা হয়েছে।
বয়স্ক মানুষের সংখ্যাধিক্য
ইতালিতে মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে সেখানকার বয়স্ক মানুষের সংখ্যাধিক্য। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে ইতালিতে সবচেয়ে বেশি বয়স্ক মানুষের বসবাস। মার্কিন সংবাদপত্র ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর তথ্য অনুযায়ী, সেখানকার অধিবাসীদের ২৩ শতাংশই ৬৫ কিংবা তার চেয়ে বেশি বয়সী।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইতালির জনগোষ্ঠীর বয়সের মধ্যক ৪৭.৩ (মধ্যক হলো মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে বয়সের একটি কেন্দ্রীয় মান নির্ণয় করা এবং সেই মানের নিচের ও ওপরের বয়সী বিবেচনায় জনগোষ্ঠীকে দুইভাগে ভাগ করা)। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীদের বয়সের মধ্যক ৩৮.৩। ‘দ্য লোকাল’র তথ্য অনুযায়ী, ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃতু্য হয়েছে তাদের অনেকেরই বয়স ৮০ ও ৯০-এর ঘরে।
‘টেম্পল ইউনিভার্সিটি কলেজ অব পাবলিক হেলথ’র রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ক্রিস জনসন মনে করেন, বয়সের পাশাপাশি কেউ যদি অন্তত এমন একটি রোগে আক্রান্ত হন, যা তাদের রোগ প্রতিরোধের সক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয় (যেমন ক্যান্সার কিংবা ডায়াবেটিস)। তবে ওই ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন এবং তাকে মারাত্মক রকমের ভুগতে হয়।
একই অঞ্চলে বেশিসংখ্যক আক্রান্ত থাকা
ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের রোগতত্ত্ববিষয়ক সহযোগী অধ্যাপক অব্রি গর্ডন মনে করেন, ইতালিতে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার আরেকটি কারণ হতে পারে, এক এলাকায় অনেক বেশি আক্রান্ত থাকা, যাদের কিনা চিকিৎসা সেবা জরুরি। একটি অঞ্চলে অনেক বেশি আক্রান্ত থাকলে সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে যায়; যেমনটা চীনের উহানে হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চীনের উহানে করোনায় মৃতের হার ৫.৮ শতাংশ। আর গোটা দেশে মৃতের হার ০.৭ শতাংশ।
মৃদুভাবে আক্রান্তদের শনাক্ত না করা
ইতালিতে করোনাভাইরাসে মৃদুভাবে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন মানুষদেরকে শনাক্ত করা কিংবা আক্রান্তের তালিকায় যুক্ত করা হয়নি। সেক্ষেত্রে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা জানা যাচ্ছে না। মারাত্মকভাবে আক্রান্তদের সংখ্যাই কেবল জানা যাচ্ছে। তাই আক্রান্তের যে সংখ্যার কথা বলা হচ্ছে, তার বিপরীতে মৃতু্যহার বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে দেখা যায় সেখানে আক্রান্তের সংখ্যার তুলনায় মৃতু্য হার কম। বিজনেস ইনসাইডারের তথ্য অনুযায়ী, সেদেশে রোগ নির্ণয় পরীক্ষায় ১ লাখ ৪০ হাজার আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে। এ সংখ্যার বিপরীতে তাদের মৃত্যু হার ০.৬ শতাংশ। আক্রান্তের সংখ্যাটা কম দেখানো হলে তাদের মৃত্যু হারও বেশি হয়ে যেত।
এ প্রসঙ্গে ক্রিস জনসন বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে কতজন আক্রান্ত হয়েছেন তা সম্ভবত আমরা জানি না। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণগুলো খুব মৃদু আকারে দেখা গেছে কিংবা যাদের বয়স কম তারা অনেকে হয়তো পরীক্ষা করাতে যাননি।’ তার সন্দেহ, ইতালিতে সম্ভাব্য মৃত্যু হার ৩.৪ শতাংশ।
সংস্কৃতিগত প্রভাব
অধ্যাপক ডেলা গিউস্তারের মতে ইতালীয়দের বেশি বাইরে বের হওয়ার প্রবণতা ও স্পর্শের সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। তিনি বলেন, আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য কিংবা আয়ারল্যান্ডের মানুষ পরস্পরের মধ্যে যতটুকু ব্যবধান রাখে ইতালির ক্ষেত্রে সেই ব্যবধান অনেক কম থাকে। সেখানকার মানুষ একে অপরকে হ্যালো বলার সময় চুমু খায়।
আক্রান্ত এলাকায় স্কুল বন্ধ করে দিয়েও অনেক অভিভাবককে বিচ্ছিন্ন (আইসোলেশন) রাখা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন অধ্যাপক ডেলা গিউস্তা। তিনি বলেন, ‘লোম্বার্দি এলাকায় স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার পরও অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের অন্যান্য অঞ্চলের পর্বত ও সমুদ্র এলাকায় ছুটি কাটাতে নিয়ে গেছে। তারা ভেবেছিল বাচ্চাদের তারা নিরাপদ রাখছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে এ ধরনের আচরণের ফলাফল ভালো হয়নি।’
পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনার সংকট
কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ইতালিজুড়ে নতুন করে আরও যেসব কড়াকড়িমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা কেবল নজিরবিহীনই নয়, অস্থিতিশীলও। লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক জন এডমুন্ড বলেছেন, এ ধরনের বিধিনিষেধের প্রভাব খুব স্বল্পমেয়াদি হবে। দীর্ঘমেয়াদে এগুলোর বাস্তবায়ন না হলে মহামারি অবস্থা আরও বেশিদিন থেকে যাবে বলে শঙ্কিত তিনি। অবশ্য ইতালির বর্তমান পদক্ষেপগুলোকে ‘অসাধারণ’ ও ‘পুরোপুরি যথার্থ’ বলে উলেস্নখ করেছেন অধ্যাপক ডেলা। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে সরকারের প্রতিক্রিয়া খুব ধীর ছিল।’