মানবিক বিবেচনায় মাওলানা সাঈদীকেও মুক্তি দেয়ার অনুরোধ
কারাবন্দী মুফাসসির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মতো মানবিক দিক বিবেচনায় মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে আলেম-উলামাসহ বিভিন্ন মহল থেকে। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওবার্তা ও স্ট্যাটাস দিয়ে এবং বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি এ অনুরোধ জানিয়েছেন। পরিবারের সদস্যরাও সরকারের ইতিবাচক মনোভাব পেলে সরকার যেভাবে চাইবে সেভাবেই উদ্যোগ নিতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন।
মাওলানা সাঈদীর মেঝ ছেলে শামীম বিন সাঈদী বলেন, জাতীয় এই দুর্যোগের সময় মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছেন। আমার আব্বাও বিপদগ্রস্ত। তার বয়স ৮১ বছর। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের সমস্যায় ভুগছেন। হৃদযন্ত্রে রিং পরানো আছে, সুগার ওঠানামা করে। তাকে এই সময়ে পরিবারের কাছে থেকে সেবা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যাতে একই মানবিকতা ও উদারতার পরিচয় দেন- সেই অনুরোধ জানাচ্ছি।
মাওলানা সাঈদী বর্তমানে আজীবন মৃত্যুদণ্ডের সাজায় কাশিমপুর কারাগার-১ এ বন্দী রয়েছেন। ২০১০ সালের ২৯ জুন তাকে গ্রেফতার করা হয়। ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হলে সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই দিনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে ৭৪ জন নিহত হয়। পরের দিন পয়লা মার্চসহ রায়কে কেন্দ্র করে ২৪৭ জন প্রাণ হারান বলে মাওলানা সাঈদীর পরিবার সূত্র জানায়। এরপর ২০১৪ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে মাওলাানা সাঈদীর সাজা কমিয়ে আজীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
শামীম বিন সাঈদী বলেন, আমরা তো বাবার মুক্তি চেয়েই আসছি। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো আবেদন আমরা জানাইনি। আমাদেরকেও সুযোগ দেয়া হলে আমরা আবেদন জানাব। আমরা মানবিক দিক থেকেই তাকে মুক্তি দেয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। আশা করি প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে বিষয়টি বিবেচনা করবেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার পর মাওলানা সাঈদীকে মুক্তি দেয়ার বিষয়টি নিয়ে সরকারের মধ্যেও কিছুটা আলোচনায় রয়েছে। বিশেষ করে রাজনীতির বাইরে মাওলানা সাঈদীর জনপ্রিয়তার দিকটি সরকারের শীর্ষপর্যায়ে পরিষ্কার থাকায় এ মুহূর্তে সরকার উদারতার পরিচয় দিলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আরো বেশি প্রভাব পড়বে- এমন একটি আলোচনাও রয়েছে।
মুক্তি দেয়া হলে মাওলানা সাঈদী আর কখনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না- এমন প্রতিশ্রুতির কথাও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কোনো কোনো মহল থেকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেও একটি সূত্র জানিয়েছে। মাওলানা সাঈদীর পরিবারের একাধিক সদস্যও জানিয়েছেন, এমনিতেই বয়স এবং শারীরিক অবস্থার কারণে তার পক্ষে আর রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কোনো সুযোগ নেই। সরকার যে শর্তই দিক পরিবার তা মেনে নিতে প্রস্তুত রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার পর মাওলানা সাঈদীর নিজ দল জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকেও মানবিক দিক বিবেচনায় মাওলানা সাঈদীসহ কারাগারে বন্দী ষাটোর্ধ্বদের মুক্তি দেয়ার আহবান জানানো হয়েছে।
ভিডিওবার্তায় বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও মুফাসসির আল্লামা কামালউদ্দিন জাফরী বলেন, আমি মনে করি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তি দিলে আমরাও মনে রাখব এবং জাতিও এটার একটা স্বীকৃতি আপনার প্রতি দেবে। কাজেই আমি আপনার প্রতি সনির্বন্ধ অনুরোধ করবো আপনি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে জেল থেকে মুক্তি দেবেন। সাথে সাথে এটাও বলবো, আপনি উদারতা দেখিয়েছেন, উদারই থাকেন। এখন আলেম-উলামা সবাই মিলে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে।
ফেসবুক লাইভে গিয়ে ২৫ মার্চ আবেগঘন বক্তব্য দিয়ে ‘আল্লাহর ওয়াস্তে’ মাওলানা সাঈদীকে মুক্তি দিয়ে তাকে দিয়ে জাতীয়ভাবে দুর্যোগ থেকে মুক্তির জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি।
তিনি খালেদা জিয়ার মুক্তিকে স্বস্তিদায়ক আখ্যায়িত করে বলেন, এ জন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। এই সিদ্ধান্তের কারণে তিনি অনাদিকাল আলোচিত থাকবেন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এ জন্য তিনি অনেক দোয়ার উপলক্ষ হবেন। রাষ্ট্রশক্তির কারণে যারা মজলুম হয়েছেন তাদের ব্যাপারেও প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবেন বলে কামনা করি। তিনি বলেন, আপনি যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মুক্তি দান করুন আল্লাহর ওয়াস্তে। আপনার দুনিয়ার কোনো আইনকানুনের দিকে তাকানোর দরকার নেই। আপনি শুধু পবিত্র কালামে পাকের দিকে তাকান, যে কালামে পাক আপনি তিলাওয়াত করেন এবং কেবল আল্লাহ পাকের দিকে তাকান যিনি অশেষ রহমত ও বরকতের আধার। এই সঙ্কটময় সময়ের কথা চিন্তা করুন, আপনার বয়সের কথা চিন্তা করুন এবং মানবতার কথা চিন্তা করুন। অনেক ঘটনায় ইতিহাস অনেক সময় পরিবর্তন হয়ে যায়। এই জমিনে কখন কে যে কার বন্ধু হয়ে যায়, বান্ধব হয়ে যায়, সঙ্গী হয়ে যায় এটা শুধু আল্লাহ জানেন। এমন ঘটনা ইতিহাসে বহুবার ঘটেছে।
সোয়া ১৪ মিনিটের এই ভিডিওতে রনি আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে বলেন, সময় খুব অল্প। এই দুনিয়ায় কে কত দিন বাঁচবে জানি না। আপনি আল্লামা সাঈদীকে মুক্তি দিন, আল্লাহর ওয়াস্তে মুক্তি দিন। আল্লাহর ফায়সালার জন্য অপেক্ষা করুন। সময় আপনার অনুকূলে যাবে। সবাই আপনার জন্য দোয়া করবে। আমি আশা করছি আপনি সাঈদী সাহেবকে মুক্তি দেবেন, তিনি জেল থেকে বের হয়ে আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন দেশের আলেম-উলামাদের নিয়ে। আমরা অশ্রুজ্বলে আল্লাহর রহমত ও বরকত চাইব, বাংলাদেশের মাটি থেকে করোনাকে আল্লাহ যেন সরিয়ে দেন।
শায়খুল হাদিস আল্লমা আজিজুল হকের (রহ:) ছেলে মাওলানা মোহাম্মদ মামুনুল হক তার ফেসবুক লাইভে খালেদা জিয়ার মুক্তির পর বলেন, এ ধরনের একটা জরুরি পরিস্থিতিতে দেশ একটা ঐক্যবদ্ধ অবস্থায় আসা জরুরি। কারাগারে বহু মানুষ রয়েছেন যারা অনেক অন্যায় ও দুর্ভোগের শিকার। তাদের যদি মুক্তি দেয়া হয়- কারামুক্তি প্রদান এটিও আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতের কারণ হবে।
এ ছাড়া পৃথক ভিডিওবার্তায় মাওলানা সাঈদীকে মানবিক কারণে মুক্তি দেয়ার অহ্বান জানিছেন প্রখ্যাত মুফাসসির ও খতিব মাওলানা লুৎফুর রহমান, মাওলানা আমিনুল ইসলাম বেলালী, টেকেরহাটের পীর মুফাসসির মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ আজহারীসহ অনেকে। ছাত্র খেলাফতের সভাপতি মাওলানা খোরশিদ আলমসহ অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাওলানা সাঈদীর মুক্তি দাবি করেছেন।
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলেম আল্লামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, হাফেজ্জী হুজুরের ছেলে মাওলানা আতা উল্লাহসহ দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমরা এক বিবৃতিতে মানবিক দিক বিবেচনা করে মাওলানা সাঈদীকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন যা গত শুক্রবার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
গত ২৪ মার্চ বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর থেকেই মাওলানা সাঈদীর মুক্তির দাবিটি ওঠতে থাকে। বেগম খালেদা জিয়াকে শর্ত সাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য সাজা মওকুফ করে গত ২৫ মার্চ দুপুরে মুক্তি দেয়া হয়।