হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৪০,০০০ হাজার নার্সের সংকট

ইংল্যান্ডে গত ৭ বছরে ৩০০ নার্সের আত্মহত্যা

অতিরিক্ত কাজের চাপ আর অর্থনৈতিক টানাপোড়ান এর মূল কারণ

এমএফএ জামান: আজ মহামারী করোনায় সারা বিশ্বের মতো বিলেতও দিশেহারা। প্রতিদিন কয়েকশ লোক হাসপাতালের দোয়ারে কড়া নাড়ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৪০০০ বেশি লোক মৃত্যুবরণ করেছেন এবং ৩৮ হাজারের বেশি লোক চিকিৎসাধীন আছেন। আর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের হাসপাতালগুলোর ডাক্তার এবং নার্সরা আজ দিনরাত রোগীর সেবায় নিয়োজিত।

কিন্তু এই ডাক্তার এবং নার্সদের খবর হয়তো আমরা জানি না। গত ৭ বছরে এনএইসএসের প্রায় ৩০০ নার্স আত্মহত্যা করেছেন। এর পিছনের মূল কারণ হলো দায়িত্বের বেশি কাজের বোঝা; যা তাদের প্রতিদিনের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিলো। কনজারভেটিভ শাসনামল থেকে এনএইসএসের আর্থিক তহবিল হ্রাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। এরফলে হাসপাতালগুলোর ডাক্তার এবং নার্সদেরকে ‍শুধু রোগীদের সেবা ছাড়াও অন্যান্য দায়িত্বগুলো সম্পন্ন্ করতে হতো। এর প্রভাব তাদের ব্যক্তিগত জীবনে গিয়ে পড়ে যা অনেকটা পর্দার আড়ালেই থেকে যায়।
আমরা যদি একটু খেয়াল করি গত কয়েক বছরে এই নার্সদের আত্মহত্যার সংখ্যাটা কেমন ছিলো; তবেই আমাদের চোখ খুলবে; যেমন ২০১১ সালে ৪৪ জন নার্স, ২০১২ সালে ৪৩ জন নার্স, ২০১৩ সালে ৩৮ জন নার্স, ২০১৪ সালে ৫৪ জন, ২০১৫ সালে ৪৩ জন নার্স, ২০১৬ সালে ৫১ জন নার্স এবং ২০১৭ সালে ৩২ জন নার্স।
এই ভুক্তভোগী নার্সদের পরিবার আজ সত্যিই বাকরুদ্ধ। তাদের পরিবারের অনেকেই জানতেন না জীবিত থাকাকালীন এই কষ্টের কথা। আজ তাদের পরিবারের দাবী এই মূল্যবান জীবনগুলোকে রক্ষা করতে সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

সারা দেশে আমাদের এনএইচএসের হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৪০,০০০ হাজার নার্সের সংকট রয়েছে। যা দিয়ে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সত্যিই অসম্ভব এবং কষ্টকর। আর আর্থিক সংকট এবং অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে অধিকাংশ নার্স কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছে। তাই সরকারকে এই বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লুসি ডি ওলিভেরা, লিভারপুলের জন মরিস ইউনিভার্সিটির নার্সিং বিষয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায় ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন। ঐ সময় লুসি ট্রেনিংয়ের জন্য হাসপাতালে বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতেন শুধু অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিন্তু এরপরও তাকে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি কাজ করতে হতো। তখন সে তার জমানো অর্থ দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের খরচ, বাসা ভাড়া, যাতায়াত ইত্যাদি সামলাতে গিয়ে অনেকটা হিমসিম খেতেন। কারণ সব খরচের পর মাস শেষে তার কাছে মাত্র ৬ পাউন্ড অবশিষ্ট থাকতো। খাবারের টাকা জোগাড় আরেকটা খন্ডকালীন কাজ শুরু করেন। আর এই সবকিছু তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলে যা তাকে আত্মহত্যার দিকে প্ররোচিত করে।
তার মা মিসেস লিজ বলেন, সে প্রতিদিন ১২ ঘন্টা হাসপাতালে নার্সিং এরপর একটি পিজ্জা শপ ও কেয়ার হোমে কাজ করতো। কারণ হাসাপাতালের কাজ থেকে তার কোনো আয় ছিলো না। ‍লুসির মতো এইসব নার্সদের প্রশিক্ষণের সময় অনেক বেশি কাজ করতে হয় যা একজন মানুষকে শারিরীক ও মানষিকভাবে অসুস্থ করে তোলো। আজ আমার মেয়ে লুসিকে আর ফিরো পাবো না কিন্তু আমি চাই না তার মতো একজন প্রাণ হারিয়ে প্রতিভার অপচয় হোক।
এই ঘটনার মাত্র ৭ দিন পর ২৪ বছর বয়স্ক চার্লঅট হিলারী ল্যাঙ্কশায়ারে তার বাসায় আত্মহত্যা করেন। এজ হিল ইউনিভার্সিটি থেকে নার্সিংয়ের কোর্সে থাকাকালীন স্থানীয় হাসাপাতালে কাজ করতেন। তার মা বলেন, আমার মেয়ে চার্লঅটকে হাসপাতালের কাজের আতিরিক্ত চাপ একেবারে নিঃশেষ করে দিয়েছিলো। সে তার কাজের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলো। কিন্ত সেখানকার কাজের ধরণ তার জীবনকে বিষন্ন করে তুলে। আর এটিই হয়তো তার মূল্যবান জীবনটাকে শেষ করে দিয়েছে।
রয়েল কলেজ অব নার্সিং এর প্রধান ডেমি ডোনা কিনায়ার এইসব মূল্যবান জীবনগুলো রক্ষার্থে সরকারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, যারা মানুষের জীবন রক্ষায় সেবিকা হিসেবে কাজ করছেন কিন্তু তাদের জীবনটা আজ হুমকীর সম্মুখীন। যা সত্যিই হৃদয়বিদারক ঘটনা। গত কয়েক বছর যাবৎ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস আর্থিক সংকটের কারণে যথাযথভাবে সেবা প্রদান করতে পারছেনা। যার প্রতিফলনটা পড়ছে সেখানে দায়িত্বরত ডাক্তার আর নার্সদের উপর। আমাদের নার্সরা অভিযোগ করেন যে, কর্মরত অবস্থায় তাদের স্বাস্থ্য এবং মানষিক চাপের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ সত্যিই উদাসীন। অনেক সময় তাদেরকে কর্মস্থলে অপদস্থের শিকার হতে হয়। কিন্তু সংকোচ আর ভয়ে তারা এটি কাউকে বলতে পারে না। এছাড়া হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ধারণা যে, নার্সরা এই সমস্যাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয়ে উঠেনা। তাই আমাদের সবাইকে এই বিষয়টি নিয়ে আরো সচেতন হতে হবে। আর তা না হলে এভাবে অনেক মূল্যবান জীবন ঝরে যাবে।

আমিন আব্দুল্লাহ (৪১) যিনি ছিলেন একজন প্রতিভাবান এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত নার্স কিন্তু অন্যায়ভাবে তার চাকুরী হারানোর পর থেকেই তিনি হতাশা আর লজ্জায় ভুগতে থাকেন। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে চাকুরী বিষয়ক মামলার রায় ঘোষণার ঠিক আগের দিন আত্মহত্যা করেন। যদিও নিরপেক্ষ তদন্তে তিনি নির্দোশ প্রমাণিত হন এবং এনএইসএস এজন্য ক্ষমা চায়।
ইংল্যান্ডের একটি জাতীয় পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল মধ্যে ৩০০ জন নার্স আত্মহত্যা করেছেন যার মধ্যে শুধুমাত্র ৩২ জন নার্স আত্মহত্যা করেন ২০১৭ সালে। এদের বেশিরভাগের বয়স ছিলো ২০ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। তবে শংকার বিষয় হলো, নার্সদের মধ্যে আত্মহত্যার মাত্রা অন্যান্য আত্মহত্যা থেকে প্রায় ২৩% বেশি। এই পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে ২০১৪ সালে প্রতি সপ্তাহে ১ জনেরও বেশি নার্স এই মানষিক চাপ সামলাতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। প্রতিদিন কর্মস্থলে তাদেরকে বিভিন্ন ধরণের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। কারণ হাসপাতালে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহত ব্যক্তির বিভৎস অবস্থা অথবা কোনো ব্যক্তি, শিশুর মৃত্যু কর্ত্যবরত নার্সদের জীবনে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর সাথে প্রতিদিন দীর্ঘসময় কাজের চাপের কারণে তাদের নিজেকে একটু সেবা-শুশ্রষা করার সেই সুযোগটা আর হয়ে উঠেনা। তাদের পরিবার-সন্তান রয়েছে অন্য সবার মতো। কিন্তু আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক জীবনটা অনেক কঠিন হয়ে উঠে। কিন্তু যখন এসব অসুবিধাগুলো আর সামলাতে পারেন না তখনই হয়তো যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই অপমূত্যুর পথটি বেছে নেন।

২০২০ সালের করোনা মহামারীর চিকিৎসাকালীন সময়ে লন্ডনের একটি হাসপাতালে রোগীদের দুর্ভোগ আর মৃত্যুর ঢল দেখে একজন কর্তব্যরত নার্স আত্মহত্যা করেন। কারণ বর্তমানে সব হাসপাতালে ডাক্তার এবং নার্সদের সংকট থাকার কারণে তাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা বিরামহীন কাজ করতে হচ্ছে।

পরিসংখ্যানে আরো বলা হয়, আত্মহত্যার প্রবণতা মহিলা নার্সদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। লওরা হেইড যিনি ডেরিফোর্ড হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু অতিরিক্ত কাজের চাপে তিনি ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন। এছাড়া রয়েল স্টক ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের নার্স এন বার্ডেট ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন। এই ৫১ বছর বয়সী নারী এর আগে ২ বার আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে মানষিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। তার স্বামী এন্ড্রু ওয়ার্ড বলেন, বার্ডেটের কাজের অতিরিক্ত চাপের পাশাপাশি কিছু পারিবারিক সমস্যা ছিলো। সবকিছু তাকে জীবনের প্রতি অনাগ্রহ করে তুলে। ১৯ মে তার সব স্বপ্নকে শেষ করে দেয় আত্মহত্যা মাধ্যমে। তাই আমি মনে করি হেলথ সার্ভিসের কর্মরত নার্স-ডাক্তারদের মানষিক স্বাস্থ্যের খেয়াল ও উন্নয়নের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরী।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের করোনা মহামারীর চিকিৎসাকালীন সময়ে লন্ডনের একটি হাসপাতালে রোগীদের দুর্ভোগ আর মৃত্যুর ঢল দেখে একজন কর্তব্যরত নার্স আত্মহত্যা করেন। কারণ বর্তমানে সব হাসপাতালে ডাক্তার এবং নার্সদের সংকট থাকার কারণে তাদেরকে ঘন্টার পর ঘন্টা বিরামহীন কাজ করতে হচ্ছে। সেই সাথে প্রতিদিন হাসপাতালে কয়েশ রোগী মৃত্যুবরণ করছে যা হয়তো তাদের অনেকেই জীবনে দেখেননি। রয়েল কলেজ অব নার্সিং এর প্রধান ডেমি ডোনা কিনায়ার বলেন, সারা দেশে আমাদের এনএইচএসের হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৪০,০০০ হাজার নার্সের সংকট রয়েছে। যা দিয়ে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সত্যিই অসম্ভব এবং কষ্টকর। আর আর্থিক সংকট এবং অতিরিক্ত কাজের চাপের কারণে অধিকাংশ নার্স কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছে। তাই সরকারকে এই বিষয়ে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button