রাতারগুলের সবুজ অরণ্যে
মোঃ কয়েছ মিয়া: রাতারগুল বনঘেঁষা পাহাড়ি সৌন্দর্য আপনাকে আবেগপ্লুত করবে, প্রাণে দোলা দেবে আর মন ভরিয়ে দেবে সতেজতায়। এখানে প্রকৃতি অকৃপণ। তার যাবতীয় ভালোবাসা সে উজাড় করে দিয়েছে। বনের ভেতর যেতে হয় চিরিঙ্গি বিল পার হয়ে। চিরিঙ্গি বিল আর তার বুকজুড়ে বয়ে চলা বিভিন্ন ধরনের নৌকা, সঙ্গে জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্যথ সব কিছুতেই আছে
অবর্ণনীয় সৌন্দর্য। প্রতিটি জীবনই চায় প্রতিযোগিতা এড়িয়ে নির্ঝঞ্চাটে বেঁচে থাকতে। প্রতিযোগিতা এড়াতে অন্য অনেক প্রাণীর মতো প্রকৃতিতে কিছু গাছপালা অভিযোজিত হয়েছে জলা এলাকার জন্য। এখানে অন্য কোনো গাছ জন্মাতে পারে না। তাই মাটির পুষ্টি সংগ্রহে এসব গাছকে প্রতিযোগিতায় পড়তে হয় কম। স্বাভাবিকভাবেই এসব গাছ পানিসহিষ্ণু হয়। জলাভূমিতে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ, লতা-গুল্ম প্রাকৃতিকভাবেই জলে।
কিন্তু এসবের সঙ্গে পানিসহিষ্ণু বড় বড় গাছপালা জলে একটা বনের আকার ধারণ করলেই তাকে বলা হয় জলবন বা সোয়াম্প ফরেস্ট। উপকূলীয় এলাকার সোয়াম্প ফরেস্টগুলো সবসময় পানিতে ডুবে থাকে। অন্যান্য এলাকায় এ ধরনের বনগুলোর গাছপালা বর্ষায় আংশিক ডুবে থাকে। সুন্দরবনও একটি সোয়াম্প ফরেস্ট। এ উপকূল ছাড়া এ ধরনের বন দেখা যায় বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহের জলাভূমিতে। ভ্রমণপিপাসুদের প্রাণে দোলা দেয় রাতারগুলের সবুজ অরণ্যের নীল জল। সারা পৃথিবীতে ফ্রেশওয়াটার সোয়াম্প ফরেস্ট বা স্বাদুপানির জলাবন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশ আছে এর দুইটি একটা শ্রীলংকায় আর আরেকটা আমাদের সিলেটের গোয়াইনঘাটে।
চলুন জেনে নেই রাতারগুল কোথায় অবিস্থিত। সিলেট জেলার গোয়াইনঘাটের কাছে রাতারগুল নামে এমনি এটি সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলবন আছে। সেটা গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। দেখলে মনে হবে সুন্দরবন। এটি দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাছে সিলেটের সুন্দরবন নামেই পরিচিত। পুরো বনের আয়তন ৩ হাজার ৩২৬.৬১ একর। বর্ষায় ৪ মাস বনটি পানিতে ডুবে থাকে। বনের কোনো কোনো অংশ পানির ৮-১০ ফুট নিচে ডুবে থাকে। আবার কোথাও কোথাও পানির গভীরতা ২০-২৫ ফুট পর্যন্ত। মোট বনের ৫০৪ একর ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয়। ঘন গাছের সারিতে পূর্ণ এ বন। গাছের নিচের অনেকাংশই ডুবে থাকে পানিতে। গাছের মধ্যে করচই বেশি। বটও আছে অনেক। রাতারগুল মূলত প্রাকৃতিক বন হলেও এখানে কদম, হিজল, বেত, মুর্তাসহ নানা প্রজাতির পানিসহিষ্ণু গাছ লাগিয়েছে বনবিভাগ। ফলে বনটি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে।
সিলেটের অন্যান্য বনে সাধারণত যেসব প্রাণী দেখা যায় বর্ষার পানিতে ডুবে থাকায় এ বনে এদের অনেককেই দেখা যায়। বিভিন্ন প্রজাতির গুইসাপ, সাপ, বেজি বর্ষায় দেখা যায় না। পাখির মধ্যে বক, কানিবক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, তুপি, ঘুঘু, চিল ও বাজপাখি দেখা যায়। শীতে আসে বিশালাকার শকুন। আর লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এ বনে আসে হাঁসসহ নানা প্রজাতির অতিথি পাখি। বর্ষায় এ বনে টেংরা, পুঁটি, খলিশা, পাবদা, রিঠা, মায়া, আইড়, কালিবাউশ ও রুইসহ বহু প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যায়। গাছপালার মধ্যে পিঠালি, অর্জুন, ছাতিয়ান, গুটিজামও দেখা যায়।
উল্লেখ্য, আমাজানসহ পৃথিবীর অনেক অঞ্চলেই সোয়াম্প ফরেস্ট বা জলবন রয়েছে। মেক্সিকোর বিখ্যাত পেনাটানোস ডি সেন্টলার বনের একটি বড় অংশও বছরের কখনো কখনো পানিতে ডুবে থাকে। উসুমাচিন্তা আর গ্রিজলভা নদীর বদ্বীপে জন্ম হয়েছে ১৭ হাজার ২০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বনটির। এছাড়া কঙ্গো, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাপুয়া নিউগিনি, থাইল্যান্ড, ভারত ইত্যাদি অনেক দেশে বেশকিছু সোয়াম্প ফরেস্ট রয়েছে। তবে কঙ্গোর পশ্চিম কঙ্গোলিয়ান সোয়াম্প ফরেস্ট নামের বনটি দখল করে আছে পৃথিবীর মোট সোয়াম্প ফরেস্টের বেশ বড় একটি অংশ। তবে তুলনামূলক ছোট হলেও সিলেটের রাতারগুল বাংলাদেশের আশ্চর্য সুন্দর এক জলবন বা সোয়াম ফরেস্ট।
কিভাবে যাবেন?
রাতারগুল যাওয়া যায় বেশ কয়েকটি পথে। তবে যেভাবেই যান, যেতে হবে সিলেট থেকেই। সিলেট-জাফলংয়ের গাড়িতে উঠে নেমে যাবেন সারিঘাট। এখান থেকে টেম্পোতে করে গোয়াইনঘাট বাজার। বাজারের পাশেই নৌঘাট। সেখান থেকে ট্রলার যোগে রাতারগুল বিট অফিস। এখান থেকে রাতারগুল যাওয়া-আসার জন্য নৌকা রিজার্ভ করতে হবে। তবে আগে ভাড়া নির্ধারন করে নেবেন। গোয়াইনঘাট থেকে রাতারগুল যাওয়ার পথটা কিন্তু ভারি চমৎকার, বিশেষ করে বর্ষায়। নদীর চারপাশের দৃশ্যের সঙ্গে উপরি হিসেবে দেখবেন দূরে ভারতের উঁচু উঁচু সব পাহাড়। তবে মনে রাখবেন, এই নৌকায় করে কিন্তু রাতারগুল বনের ভেতরে ঢোকা যাবে না। বনে ঢুকতে হবে ডিঙি নৌকায় চেপে। আবার সিলেট থেকে সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে চলে যেতে পারেন শালটিকর। সেখানকার নৌঘাট থেকে নৌকা রিজার্ভ করে রাতারগুল যাওয়া-আসায় খরচ গুনতে হবে হাজার-বারো শ টাকাই। তবে সবচেয়ে কম সময়ে রাতারগুল পৌঁছানো যায় শ্রীঙ্গি ব্রিজ হয়ে। এতে খরচও হবে কম।
সতর্কতা
বর্ষায় রাতারগুল দেখতে সুন্দর। কিন্তু এ সময় জোঁক আর সাপের প্রকোপ বেশি। তাই সতর্ক থাকতে হবে। যাঁরা সাঁতার জানেন না, সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট রাখতে পারেন। বনে ঢুকে পানিতে হাত না দেওয়াই ভালো।