সংকট দূর হলে এনএইচএস’কে স্মরণ রাখবেন
অভিবাসীরা এনএইচএস কে দুর্বল করেনি বরং এটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে
নাসরীন মালিক: আমজেদ আল – হাউরানি ভেবেছিলেন তিনি ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি মনে করেছিলেন হয়তো কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ায় কিংবা যথেষ্ট না ঘুমোনোর ফলে এমনটি হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্বাসকষ্ট হওয়ায় তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং একটি ভেন্টিলেটর দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
তিন সপ্তাহ পর তিনি মারা যান কোভিড-১৯ সংক্রমনে। তার বয়স হয়েছিলো ৫৫ বছর। এনএইচএস এর কান, নাক ও গলা (ইউএনটি) কনসালট্যান্ট কখনো জানতে পারেননি যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।
করোনাভাইরাস পরীক্ষায় তার পজিটিভ ফল আসার অনেক আগেই তিনি ঘোরে চলে গিয়েছিলেন। এই ইএনটি সার্জারি কনসালট্যান্ট করোনাভাইরাসের কাছে বিশেষভাবে অরক্ষিত ছিলেন এবং স্বাদ ও গন্ধ কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট ও অবিরাম কাশি ইত্যাদি করোনা ভাইরাস সংক্রমন সংক্রান্ত উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের চিকিৎসা দিতেন তিনি। তার ভাই আমাল বলেন, তিনি তার কাজ করে যাচ্ছিলেন। এমনকি তার যে সুরক্ষা ব্যবস্হা গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিলো, সে ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন না।
কোমায় চলে যাওয়ার আগে চিকিৎসক আল – হাউরানির শেষ কথা ছিলো,তারা এতো দেরী করছে কেনো, আমাকে ইউটিউবেইট করা দরকার।আল হাইরানির সুদানী পিতামাতা ৬ পুত্র নিয়ে ১৯৭৫ সালে যুক্তরাজ্যে এসে বসতি স্হাপন করেন। তার মরহুম পিতা ছিলেন একজন কনসালট্যান্ট রেডিওলজিস্ট যিনি আধুনিকতম সরন্জাম ও তার ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য যুক্তরাজ্যে চলে আসেন।
তার বড় ছেলে হাউরানির মাঝে তার চিকিৎসার প্রতি আবেগটি পরিলক্ষিত হয়। তার কোন শখ ছিলো না, তিনি সব সময় পড়াশোনা করতেন, তিনি তা ভালোবাসতেন। পরিবার ও চিকিৎসার প্রতি আল হাউরানির প্রতিশ্রুতির সমাপ্তি ঘটেছে।
তার পুত্র আশরাফ বলেন, আমার পিতার অধিকাংশ সময় নিবেদিত ছিলো পরিবারের প্রতি, বাকী সময় তিনি তার পেশায় প্রদান করেন। এখন তার ঘনিষ্ট বন্ধনে আবদ্ধ পরিবার ও বিস্তৃত চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বন্ধুবান্ধবদের কমিউনিটির কেউই একত্রিত হয়ে তার জন্য শোকটুকু পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারছেন না। এছাড়া হাউরানির সত্তরোর্ধ মাতার করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তার পুত্রদেরকেও মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে এবং শোকার্তদের সরিয়ে দেয়া হয়েছে।
যখন সবকিছু স্বাভাবিক অবস্হায় ফিরে যাবে, এনএইচএস রাজনীতির একটি ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং অর্থের অভাবের জন্য দায়ী করা হবে অভিবাসীদের, তখন দয়া করে স্মরণ রাখবেন আমজেদ আল – হাউরানি ও সম্মুখসারির অন্যান্যদের যারা মানুষের জীবন বাঁচাতে জীবন দিয়েছেন।
আল হাউরানি ছিলেন ভাইরাসে মারা যাওয়া অগ্রভাগের দ্বিতীয় চিকিৎসক। সুদানী বংশোদ্ভূতদের মধ্যে প্রতিস্হাপন বিশেষজ্ঞ ডাঃ আদিল আল তাইয়ার মিডল্যান্ডসের একটি এএন্ডই বিভাগে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সহায়তা প্রদান করেন। চার সন্তান রেখে তিনিও মারা গেছেন। তার দুই পুত্রও চিকিৎসক।
চিকিৎসক আমজেদ আল – হাউরানি ও আল তাইয়ারের মৃত্যুতে আমাদের স্বাস্হ্য সেবা ব্যবস্হার প্রতি তাদের ও তাদের পরিবারের অবদান উদাহরণ হয়ে আছে।হ্যাঁ,তারা ছিলেন গিফটেড ও নিঃস্বার্থ। কিন্তু তারা ব্যাতিক্রম ছিলেন। তারা ছিলেন যুক্তরাজ্যব্যাপী এনএইচএস চিকিৎসকদের একটি কমিউনিটির অংশ, যাদের জন্ম বিদেশে কিংবা অভিবাসিদের বংশধর। সত্তর ও আশির দশকে আল হাউরানি ও তার ভাই বোনেরা যুক্তরাজ্যের এক চরম বর্ণবিদ্বেষী পরিবেশে বেড়ে ওঠেন।
তার ছোট ভাই আমাল সে সময়ের স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণে অন্য শিশুদের সাথে তিনি খেলতে পর্যন্ত পারতেন না। আজ ত্রিশ বছর পর যুক্তরাজ্য এখন অনেক বৈচিত্র পূর্ণ।
তবে অভিবাসীদের বিষয়ে একটি বিরুপ ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, বিশেষভাবে জাতীয় স্বাস্হ্য সেবা-এনএইচএস এর ক্ষেত্রে।
তা হচ্ছে অভিবাসীরা এনএইচএস-কে কিছুই দেয়নি, শুধু গ্রহণ করেছে এটা থেকে। এটা সর্বদাই একটি মিথ্যাচার। আল হাউরানি ও আল তাইয়ারের পাশাপাশি সম্মানের সারিতে ডাঃ আলফা সাদু।
তিনি এসময়ে হার্টফোর্ডশায়ারে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছিলেন। এলাকাটি দেশের সবচেয়ে বেশী ভাইরাস সংক্রমিত এলাকার একটি। এছাড়া আছেন জেনারেল প্র্যাকটিশনার ডাঃ হাবিব জাইদী এবং একজন একিউট মেডিকেল ইউনিট নার্স আরিমা নাসরীন। সংখ্যাই বলে দেয় এবং সর্বদা এই সত্যই প্রকাশ করে যে, মেডিকেল স্টাফদের ৪৪ শতাংশই বিএএমই।
নার্স ও ধাত্রীদের ক্ষেত্রে, প্রতি ৫ জনের একজন হচ্ছেন তারা। লন্ডনের মতো কিছু এলাকায় তারা হচ্ছে প্রতি ১০ জনে ৪ জন।
অবস্হা এখন এমন নয় যে সরকার ইইউ অভিবাসি নয় এমন চিকিৎসকদের জন্য যুক্তরাজ্যে কাজ করা সহজ করেছে। তাদের ব্যয়বহুল কাজের ভিসা নবায়নে হোম অফিসের আবশ্যকীয়তা পূরণের জটিল গোলক ধাঁধাঁর মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, যা প্রায়ই কাজের সাথে বাঁধা যে সব বিষয় তাদের নিজেদের বাজেটগত সীমাবদ্ধতার ওপর নির্ভরশীল। এই ধারার একটি মাত্র প্রতিবন্ধকতা দেশ থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসকদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারে।
এখন এনএইচএস-এর প্রতি সদ্য জন্ম নেয়া স্নেহ থেকে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, দেশের সকল নার্স, চিকিৎসক, প্যারামোডিক্স ও স্বাস্হসেবা পেশাজীবিদের ভিসা এক বছরের জন্য বিনা খরচে আপনা আপনি নবায়ন হয়ে যাবে। এসব অভিবাসী চিকিৎসকদের অনেককে ট্যাক্স ও জাতীয় বীমার অর্থ ছাড়াও বড়ো অংকের বার্ষিক এনএইচএস সারচার্জ পরিশোধ করতে হবে।
চলতি বছরের অক্টোবর থেকে এই সারচার্জের পরিমাণ ৪০০ পাউন্ড থেকে ৬২৪ পাউন্ডে বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সম্ভবতঃএসবই সাময়িক মুখরক্ষা ও জীবন বাঁচানোর পদক্ষেপ। যখন সবকিছু স্বাভাবিক অবস্হায় ফিরে যাবে, এনএইচএস রাজনীতির একটি ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং অর্থের অভাবের জন্য দায়ী করা হবে অভিবাসীদের, তখন দয়া করে স্মরণ রাখবেন আমজেদ আল – হাউরানি ও সম্মুখসারির অন্যান্যদের যারা মানুষের জীবন বাঁচাতে জীবন দিয়েছেন।
স্মরণ রাখবেন তাদের নাম, তাদের চেহারা, তাদের কাহিনী এবং রেখে যাওয়া তাদের পরিবারের কথা। এবং স্মরণ রাখবেন যে, অভিবাসীরা এনএইচএস-কে দুর্বল করেনি, বরং এনএইচএস বেঁচেছে অভিবাসীদের দ্বারাই।