অন্যরকম এক জুমা ও শবেবরাত
ফয়েজ উল্লাহ ভূঁইয়া: ‘আজকের দিন আমাদের জন্য একটা বেদনাবিধূর ও মনোকষ্টের দিন। এভাবে আরো কতটা জুমাবার আমাদের থেকে হারিয়ে যাবে আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। প্রতি শুক্রবারের ন্যায় আজো আমার ছেলে জুমার নামাজ আদায়ের জন্য তৈরি হয়ে আছে। আজ আমরা সবাই বাসায় গৃহবন্দী! ফেসবুকে শুক্রবার এমনই আবেগঘন স্ট্যাটাস দেন চট্টগ্রামের রাশিদ উদ্দিন শাহীন।
বায়তুল মোকাররমে প্রবেশ করতে না পেরে আবেগে কাঁন্না ধরে রাখতে পারেননি কয়েকজন মুসল্লি। উত্তরগেটের ফুটপাতে হকারের চকিতে দাঁড়িয়ে মসজিদের সাথে মিলিয়ে জামাতে অংশ নেন তারা। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও মনকে বুঝ দিতে না পেরে বিভিন্ন এলাকায় জায়নামাজ হাতে বের হলেও বাধার মুখে মসজিদে ঢুকতে না পেরে মনবেদনা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন অনেকে।
এ যেন এক অসীম শূন্যতা, অন্যরকমের হাহাকার! মাত্র ১০ জন নিয়ে জুমার জামাত! দুই-চার দশকে এমন দৃশ্য জীবদ্দশায় কে দেখেছে? শবেবরাতের রাত অথচ মসজিদে মুসল্লি নেই, রাস্তা, ইবাদত করতে বের হওয়া কিশোর-যুবকদের আনাগোনাশূন্য অলি-গলি! কবরস্থানের সামনে নেই ফকির-মিসকিনের সারি! পাঁচ ওয়াক্তের নামাজেও ইমাম মুয়াজ্জিন-খাদেমের বাইরে আর কারো যাওয়ার অনুমতি নেই! সব মানুষ ঘরে, আল্লাহর ঘর মসজিদ যেন খা খা করছে! ধর্মপ্রাণ মানুষের মন যেন কিছুতেই মানছে না কিন্তু করার যে কিছু নেই।
সারা বিশ্বের মতো মুসলিম প্রধান বাংলাদেশের মানুষও আজ গৃহবন্দী, করোনার সংক্রমণরোধে ঘর থেকে বের হওয়া মানা। মসজিদ-উপাসানলয়ে যেতে বারণ করে দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। আলেম ওলামাসহ সর্বস্তরের মানুষ সেটাকে সমর্থন করেছেন, মানছেনও।
জুমার জামাতে বাইরের লোক যাওয়ার ব্যাপারে ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা রাজধানীর অধিকাংশ মসজিদেই কার্যকর হয়। তবে অলি-গলির কিছু মসজিদে ২০-৫০জন করে মুসল্লি সব নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেও জামাতে অংশ নিয়েছেন এমন খবর পাওয়া গেছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার চিত্রও প্রায় অভিন্ন।
বায়তুল মোকাররমে খুতবার সময় প্রথম কাতারে ১৩ জন মুসল্লি বসা ছিলেন। তবে খাদেমসহ ২০ জনের মতো সেখানে উপস্থিত থাকলেও জামাতে অংশ নেন হাতে গোনা ১০ জন। বাকিদের পরে আলাদা জামাত করে নামাজ পড়ার পরামর্শ দিয়ে ইমাম চলে যেতে বলেন। তবে নামাজের বাইরে এখানে সংবাদকর্মীর সংখ্যা ছিল ২০ জনের মতো।
নামাজে খুতবা ও ইমামতি করেন পেশ ইমাম মাওলানা মুহিবুল্লহিল বাকী নদভী। তিনি আরবি খুতবার আগের বক্তব্যে করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়ায় তার বিশদ বর্ণনা তুলে ধরে সবাইকে সরকারের দেয়া সতর্কতা মেনে চলার আহবান জানান। একই সাথে দেশের শীর্ষ আলেমরা কেনো মসজিদে জামাতে না যাওয়া এবং জুমার বদলে ঘরে জোহরের নামাজ আদায়ের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছেন। তার ব্যাখ্যাও দেন। জামাত শেষে খতিব করোনাভাইরাস থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব মানুষকে মুক্তি দেয়ার জন্য কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেন।
এ যেন এক অসীম শূন্যতা, অন্যরকমের হাহাকার! মাত্র ১০ জন নিয়ে জুমার জামাত! দুই-চার দশকে এমন দৃশ্য জীবদ্দশায় কে দেখেছে? শবেবরাতের রাত অথচ মসজিদে মুসল্লি নেই, রাস্তা, ইবাদত করতে বের হওয়া কিশোর-যুবকদের আনাগোনাশূন্য অলি-গলি! কবরস্থানের সামনে নেই ফকির-মিসকিনের সারি! পাঁচ ওয়াক্তের নামাজেও ইমাম মুয়াজ্জিন-খাদেমের বাইরে আর কারো যাওয়ার অনুমতি নেই! সব মানুষ ঘরে, আল্লাহর ঘর মসজিদ যেন খা খা করছে! ধর্মপ্রাণ মানুষের মন যেন কিছুতেই মানছে না কিন্তু করার যে কিছু নেই।
এ দিকে বায়তুল মোকাররমে প্রবেশের সব পথ বন্ধ রাখা হয়। উত্তরগেট দিয়ে কয়েকজন মুসল্লি ঢুকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কোনো নামাজে এসেছেন- জানতে চাইলে জবাবে বলেন, মনকে মানাতে পারছি না- তাই এসেছি। পরে তারা হকারদের রাখা চকিতে দাঁড়িয়ে মসজিদের জামাতের সাথে অংশ নিয়ে জুমার দুই রাকাত ফরজ আদায় করেন।
রাজধানীসহ দেশের কোনো কোনো জায়গায় নিজস্ব বাসাবাড়িতে সীমিতসংখ্যক মুসল্লির উপস্থিতিতে জুমার জামাত করার খবরও পাওয়া গিয়েছে। ওয়াক্তিয়া নামাজ কোথাও বাসাবাড়ির ছাদে স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরত্ব বজায় রেখে আদায়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে।
আগের দুই জুমায় বাংলায় বক্তব্য দেয়া না দেয়া হলেও আজ শুক্রবার অধিকাংশ মসজিদেই বাংলায় বয়ান করা হয়। আজানের আগে অনেক মসজিদের মাইক দিয়ে মুসল্লিদের মসজিদে না যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়। আগের জুমায় মসজিদে উপস্থিতি সীমিত রাখার আহ্বানের পরও মসজিদের বিপুলসংখ্যক উপস্থিতি ছিল। সর্বশেষ সরকারের সরাসরি নিষেধাজ্ঞার পর আজ প্রায় সব মানুষই ঘরেই ছিলেন।
এ দিকে বৃহস্পতিবার মহিমান্বিত রজনী শবেবরাতেও মসজিদে না যাওয়ার সরকারি আহ্বান মেনে চলেছে রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ। কোনো কোনো এলাকায় কিছুটা ব্যতিক্রম হলেও পরে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে মুসল্লিরা ঘরে ফিরে যান। অধিকাংশ ধর্মপ্রাণ মানুষই নিজ ঘরে বসে কুরআন তিলাওয়াত, জিকির-আজকার, নফল নামাজ আদায় এবং দোয়া করেন। অন্যান্য বছরের শবেবরাতের মতো কবরস্থানে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের রূহের মাগফিরাত কামনা করা থেকে মানুষ বিরত থাকেন। কবরস্থানগুলোর সামনে ফকির-মিসকিনদের ভিড় ছিল না।
রাজধানীর অনেক মসজিদের মাইকে শবেবরাতের ফজিলত বর্ণনা করে ওয়াজ করেন ইমামরা। তারা বাসাবাড়িতে অবস্থানরত মুসল্লিদের বাসায় থেকে ইবাদাত করা এবং করোনা থেকে মুক্তির জন্য দোয়ার আহ্বান জানান।
শবেবরাত উপলক্ষে শুক্রবার অনেকে নফল রোজা রাখেন। ফোনে জানার চেষ্টা করলে অনেকে জানান, মসজিদে যেতে বারণ করা হবে এমন পরিস্থিতি কখনো কল্পনায়ও আসেনি। আলেমদের অনেকে এ জন্য নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সবাইকে বেশি বেশি তওবা এস্তেগফার করার কথা বলেন।