এটি কল্পনার মতো শোনাচ্ছে, তবে তা নয়
আবদুল করিম ও রানি ভিক্টোরিয়া বন্ধুত্বের সত্য গল্প
ইতিহাসের দ্বিতীয় দীর্ঘতম শাসনকর্তা হিসাবে রানি ভিক্টোরিয়ার জীবন, তার স্বচ্ছল আচরণ, যুবরাজ অ্যালবার্টের সাথে তার বিয়ে এবং আর্টের প্রতি তাদের আগ্রহ সম্পর্কে সামান্য কিছু জানা যায়। যাইহোক, ২০১৭ সালে ভিক্টোরিয়া এবং আবদুল নামে একটি চলচ্চিত্র প্রকাশের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের আরও একটি দিক উদ্ভাসিত হয়েছিল – তিনি তার জীবনের শেষ বছরগুলোতে আবদুল করিম নামে এক ভারতীয় যুবকের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
রানি হিসেবে জুডি ডেন্চ এবং তার বিশ্বস্ত হিসাবে আলি ফজল অভিনীত এই ছবিটি একই নামের ইতিহাসবিদ শ্রাবণী বসুর রচিত একটি বইয়ের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে। জুড়ি কীভাবে একে অপরের জীবনে এসেছিল, কীভাবে বছরের পর বছর ধরে তাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছিল এবং রাজপরিবারের সদস্যদের অসন্তুষ্ট করার ফলে তারা যে বাধার মুখোমুখি হয়েছিল তা এটির অনুসন্ধানে উঠে আসে।
আবদুল করিমের সাথে রানি ভিক্টোরিয়ার বন্ধুত্বের আসল গল্পটি এখানে তুলে ধরা হ’ল:
করিম, যার পুরো নাম মোহাম্মদ আবদুল করিম ১৮৬৩ সালে ভারতে একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়। এক বড় ভাই এবং চার ছোট বোনসহ তার বাবা ছিলেন এবং তিনি ব্রিটিশ অশ্বারোহী রেজিমেন্ট হাসপাতালের সহকারী হিসাবে কাজ করতেন।
তার বাবার কাজের ক্ষমতা তাকে করিমের জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেয়, যিনি ফারসি ও উর্দু শেখাতেন। যখন তিনি বড় ছিলেন, করিম আগ্রার একটি কারাগারে ক্লারিকের পদে অধিষ্ঠিত হন, যেখানে তার বাবাও তখন কর্মরত ছিলেন।
রানি ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স অ্যালবার্টের প্রাক্তন বাসভবন আইল অফ ওয়াইটের ওসবার্ন হাউসে আঁকা ছবি দেখে লেখিকা বসু প্রথমে করিমের প্রতি আগ্রহী হন। ‘আমি জানতাম যে আবদুল করিম ভারত থেকে ১৮৮৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার সেবা করতে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। ‘সুন্দরভাবে, লাল ও স্বর্ণালি রঙে’ চিত্রিত একটি বই ধরে থাকা ছবির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পেইন্টটি আমাকে বলছিল যে, একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির চরিত্র ফুটে উঠেছে’।
করিম যে কারাগারে কাজ করছিলেন সেখানে বন্দিদের পুনর্বাসন কর্মসূচি ছিল, যেখানে তাদের কার্পেট তাঁতি হিসাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। ১৮৮৬ সালে বেশ কয়েকজন বন্দি লন্ডনে একটি প্রদর্শনীতে তাদের গালিচা বুনন প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করেছিলেন। করিম কারাগারের সুপারিনটেনডেন্ট জন টেলারকে ইংরেজ রাজধানীতে ভ্রমণের ব্যবস্থা করতে সহায়তা করেছিলেন। রানি ভিক্টোরিয়া প্রদর্শনীটি পরিদর্শন করেন। ভারতের সম্রাজ্ঞী হিসাবে রানি তার শাসনাধীন ভারতীয় অঞ্চলগুলোতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
রানি টেইলারকে বলেছিলেন যে, তিনি চান তার সিংহাসনে আরোহণের ৫০ বছর পূতিতে দুই ভারতীয় সার্ভেন্টকে বেছে নেবেন, যারা সুবর্ণজয়ন্তীর সময় এক বছরের জন্য নিযুক্ত হবে। টেইলার এ পদের জন্য করিম এবং মোহাম্মদ বক্স নামে পরিচিত একজনকে বেছে নেন। করিমকে ইংরেজি শেখানো হয়েছিল এবং রানি ভিক্টোরিয়ার অপেক্ষার জন্য ইংল্যান্ড ভ্রমণের আগে ব্রিটিশ শিষ্টাচারের উপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।
করিম এবং কুইন ভিক্টোরিয়ার প্রথম সাক্ষাত কীভাবে হয়েছিল?
১৮৮৭ সালের ২৩ জুন রানি ও করিমের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিল। এদিনে আব্দুল করিম এবং মোহাম্মদ বক্স উইন্ডসর-এর ফ্রোগমোর হাউসে ৬৮ বছর বয়সী রানির জন্য নাশতা পরিবেশন করে। ফ্রগমোর হাউসে সম্প্রতি ২০১৮ সালের মে মাসে সাসেক্সের ডিউক এবং ডাচেসের বিবাহের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
করিমের সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের অল্প সময়ের মধ্যেই রানি ভিক্টোরিয়া তার ডায়েরিতে প্রকাশ করেছিলেন যে, তিনি তার দুই নতুন সার্ভেন্টের সাথে পরিচিত হওয়ার পর হিন্দুস্তানের কিছু শব্দ শিখতে শুরু করেছিলেন। শ্রাবণী বসুর বই ‘ভিক্টোরিয়া ও আবদুল: দ্য ট্রু স্টোরি অফ দ্য কুইনের ক্লোজস্ট কনফিডেন্ট’-এ লিপিবদ্ধ রয়েছে, তিনি লিখেছেন, ‘এর ভাষা ও মানুষের উভয়ের প্রতিই আমার খুব আগ্রহ, আমি স্বাভাবিকভাবেই এর আগে কখনও সত্যিকারের সংস্পর্শে আসিনি’।
সে বছর আগস্টের মধ্যেই করিম দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রধান ভাষা এবং এখন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা উর্দু রানিকে শেখানো শুরু করেছিলেন। সেখান থেকে তাদের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তায় চলে যায়, রানি ভিক্টোরিয়া অনুরোধ করেন, তাকে আরও ইংরেজি পাঠ দেয়া উচিত।
সুবর্ণজয়ন্তীর জন্য ইংল্যান্ডে আসার এক বছর পর রানি ভিক্টোরিয়া তার ব্যক্তিগত ভাষার শিক্ষক হিসাবে তার ভ‚মিকাটি বোঝানোর জন্য ১৮৮৮ সালে করিমকে ‘মুন্সি’ পদে উন্নীত করেছিলেন। তবে তাদের কথোপকথন কেবল ভাষা সংশ্লিষ্ট না। করিমের জীবনী লেখক সুশিলা আনন্দ জানিয়েছেন, এই জুটি দর্শন ও রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও কথা বলেছিল।
১৯০১ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত স্থায়ী তাদের ১৪ বছরের বন্ধুত্ব জুড়ে রানি করিমের প্রতি তার ভালবাসাকে প্রকট করে তুলেছিলেন। রাজপরিবারে তার ভ‚মিকার অংশ হিসাবে অন্যান্য ভারতীয় সার্ভেন্টদের দায়িত্ব তার হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল এবং স্কটল্যান্ডে রানির এস্টেট বালমোরাল ক্যাসলে একটি ঘর বরাদ্দও দেয়া হয়েছিল। এবং ১৮৯৯ সালে করিম রানির ৮০তম জন্মদিনে কমান্ডার অব দ্য অর্ডার (সিভিও) নিযুক্ত হয়েছিল।
যাইহোক, রাজপরিবারের অন্য সদস্যরা যুবকের প্রতি রানির সম্পর্কের অংশীদার হননি, তারা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে, তারা তাকে সার্ভেন্টের ঊর্ধ্বে মর্যাদা দিতে চায় না এবং যখন তারা করিমের প্রতি অপছন্দ প্রকাশ করে, রানি তার প্রতিরক্ষায় তার পক্ষে দাঁড়ান।
রাজপরিবার কীভাবে তাদের সম্পর্কের উন্নতিতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল?
করিমের সাথে রানি ভিক্টোরিয়ার বন্ধুত্ব সম্পর্কে অনেকেই সচেতন না থাকার কারণগুলির একটি হ’ল তাদের চিঠিপত্রের বেশিরভাগ অংশই পুড়ে গেছে। রানির জীবদ্দশায় করিমের পক্ষে তার অস্বীকৃতি স্পষ্ট করে, তার মৃত্যুর পরে তার বড় ছেলে এডওয়ার্ড আদেশ দিয়েছিলেন যে, এই জুটির মধ্যে পাঠানো চিঠিগুলি যেন নষ্ট করে দেয়া হয়।
রাজকর্মচারীরা ভিক্টোরিয়ার ঘনিষ্ঠ করিমের ‘দ্রুত অগ্রগতি’ মেনে নেয়নি। রানির জীবনী লেখক ক্যারলি এরিকসন তার ‘লিটল মেজেস্টি : দ্য লাইফ অফ কুইন ভিক্টোরিয়া’-তে বলেছেন, ‘তার জাতি সকল আবেগকে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে তার বিরুদ্ধে’।
এরিকসন লিখেন, ‘বর্ণবাদ ছিল যুগের চাবুক; এটি ব্রিটেনের বিশ্ব আধিপত্যের যথাযথতায় বিশ্বাসের সাথে একাকার হয়ে গেছে। একটি ধূসর-চামড়ার ভারতীয়কে রানির সাদা চাকরদের সাথে এক পর্যায়ে দাঁড় করানো সবই অসহ্য ছিল, তাদের মতো একই টেবিলে খেতে দেয়া, তাদের প্রতিদিনের জীবনাচার ভাগ করে নেয়া তার প্রতি আক্রোশ নিয়ে দেখা হত’।
ভিক্টোরিয়া ও আবদুল করিমের লেখক শ্রাবণী বসু টাইমকে বলেছিলেন যে, তিনি রানির চিকিৎসক স্যার জেমস রিডসহ রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগতভাবে লেখা কাগজপত্র আবিষ্কার করেছিলেন। একটি গবেষণাপত্রে রিড করিমের প্রতি যথেষ্ট আপত্তি জানিয়ে লিখেছিলেন যে, রানি ‘মুন্সী ম্যানিয়া’ তৈরি করেছেন।
ইতিহাসবিদ বলেন যে, করিমকে পশ্চিমা জীবনীগ্রন্থগুলিতে ‘দুর্বৃত্ত’ হিসাবে চিত্রিত করা হয়, ‘যিনি রানিকে বশ করেছিলেন এবং বিখ্যাত হয়েছিলেন’। সে কারণেই তিনি (লেখক) তার করিমের জীবন এবং রানি ভিক্টোরিয়ার সাথে তার সম্পর্কের বিষয়ে আরও বিশদ অনুসন্ধান করতে চেয়েছিলেন।
কীভাবে তাদের বন্ধুত্বের কথা মনে পড়ে?
রানি ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স অ্যালবার্টের প্রাক্তন বাসভবন আইল অফ ওয়াইটের ওসবার্ন হাউসে আঁকা ছবি দেখে লেখিকা বসু প্রথমে করিমের প্রতি আগ্রহী হন। ‘আমি জানতাম যে আবদুল করিম ভারত থেকে ১৮৮৭ সালে রানি ভিক্টোরিয়ার সেবা করতে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। ‘সুন্দরভাবে, লাল ও স্বর্ণালি রঙে’ চিত্রিত একটি বই ধরে থাকা ছবির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পেইন্টটি আমাকে বলছিল যে, একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির চরিত্র ফুটে উঠেছে’।
করিমের জীবন নিয়ে গবেষণা শুরুর পর বসু ভেবেছিলেন, রাজা ষষ্ঠ এডওয়ার্ডের আদেশ অনুসারে তার এবং রানি ভিক্টোরিয়ার মধ্যেকার সমস্ত চিঠিপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। তবে, তিনি করিমের বংশধরদের সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন, যারা জানান যে, তারা তার জার্নাল সুরক্ষিত রেখেছেন। করিমের নিজের কোনও সন্তান ছিল না, কারণ এবং তার স্ত্রী গর্ভধারণ করতে অক্ষম ছিলেন, তাই তার বংশধররা তার ভাইবোনদের কাছ থেকে এসেছেন।
বসু বলেন, ‘যখন [জার্নালগুলি] আমার কাছে হস্তান্তর করা হয় তখন এটি একটি আশ্চর্য মুহূর্ত ছিল। ‘একটিতে একটি লাইন রয়েছে যা বলে, ‘যার হাতে এটি পড়বে, আমি আশা করি তারা এই গল্পটি পছন্দ করবে। এবং একশো বছরেরও বেশি সময় পর এটি আমার হাতে পড়েছিল’।
ইতোমধ্যে রানি ভিক্টোরিয়া এবং করিম সম্পর্কে একটি বই লিখেছিলেন। তার জার্নালগুলোর আবিষ্কার বসুকে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশে উৎসাহ যুগিয়েছিল। এই বইটি ২০১৭ সালের ভিক্টোরিয়া এবং আবদুল চলচ্চিত্রের ভিত্তিতে পরিণত হয়েছিল, যেখানে ডেনচ এবং ফজল তারকা। যদিও ছবিটি তাদের বন্ধুত্বের একটি কাল্পনিক সংস্করণ তুলে ধরেছে, তবে বসু জোর দিয়ে বলেছেন যে, এতে চিত্রায়িত ঘটনাগুলি ঘটেছে।
‘বিষয়টি হ’ল এটি কল্পকাহিনী নয় – এটি সত্য। স্ক্রিনে যা প্রদর্শিত হচ্ছে তা বাস্তবে ঘটেছিল – এটি কিছু রান্না করা নয় ‘জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন’ রাজ নস্টালজিয়া গল্প। এটা ঘটেছে, রানি ভিক্টোরিয়া উর্দু শিখেছেন, তিনি আম চেয়েছিলেন এবং তিনি আবদুল করিমের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এটি কল্পনার মতো শোনাচ্ছে, তবে তা নয়।
বিবিসি২ টেলিভিশন ব্রিটিশ সময় শনিবার (১১ এপ্রিল) রাত সোয়া ন’টায় ‘ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আব্দুল’ সম্প্রচার করবে।