কওমি মাদরাসা নিয়ে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি
কাজী সাইদ:
সর্বশেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হলে তাকে বার্মায় নির্বাসনে পাঠানো হলো। তার ছেলেদের অনেককেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। এ আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিণত হয়েছিল উত্তর ভারত। ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভের এ রক্তয়ী সার্বজনীন আন্দোলনের ব্যর্থতার পর ভারতবর্ষের সুশিতি অভিজাত মুসলমানদের মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মালো, ভারতবর্ষে মুসলমানেরা ব্রিটিশদের গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ থেকে তাদের রাজনৈতিক প্রাধান্য হারাতে বসেছে এবং মুসলমানদের জন্য এক কালো ইতিহাসের সূচনা শুরু হলো। এমনতর পরিস্থিতিতে মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানৌতভির নেতৃত্বে উত্তর ভারতের কিছু ইসলাম ধর্মতত্ত্ববিদ এক হয়ে উত্তর প্রদেশের শাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে ২১ মে ১৮৬৬ সালে (হিজরি ১২৮৩ অব্দ) একটি ডালিমগাছের নিচে প্রতিষ্ঠা করেন ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ বিদ্যালয়। নানৌতভির সাথে প্রতিষ্ঠতা আলেম যাদের নাম উল্লেখ না করলেই নয়, তারা হলেন মাওলানা রাশিদ আহমদ গঙ্গোহি ও হাজী সাইয়েদ আবিদ হোসেন। প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সা: থেকে স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েই নানৌতভি এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে নানৌতভির ভাষ্য থেকে জানা যায়। প্রতিষ্ঠাতাদের মহৎ উদ্দেশ্য ছিল ইসলামিক সংস্কৃতির সংরণ এবং ছেলেমেয়ে ও তরুণদের মধ্যে ইসলামি জ্ঞান অর্জনে প্রকৃত শিা দেয়া। সত্যিকার আলেম-ওলামা মাশায়েখ, ইসলামি চিন্তাবিদ সৃষ্টির কারিগর হিসেবে দারুল উলুম দেওবন্দ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং নন্দিত সবচেয়ে বড় ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। এ পর্যন্ত দেওবন্দের পনেরো হাজারেরও বেশি স্নাতক ও মাস্টার্স দণি এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেওবন্দের আদলে হাজার হাজার মাদরাসা, মক্তব প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসবই কওমি মাদরাসা নামে পরিচিত।
দেওবন্দের শিাপদ্ধতি
যুগের চাহিদা ও ইসলামি গবেষণালব্ধ জ্ঞানের উৎকর্ষতার সাথে দারুল উলুম দেওবন্দের সিলেবাস পরিবর্তিত হয়েছে। দেওবন্দের কারিকুলাম সপ্তদশ শতাব্দীর ইন্দো-ইসলামিক সিলেবাস ‘দারস-ই-নিজামি’র অত্যাধুকি সংস্করণকে ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে।
পবিত্র কুরআন ও এর বিশেষ দিক নিয়ে শিা কারিকুলামের মূল ভিত্তি। হাদিস ও তার সমসাময়িক মতামত, ইসলামি আইনশাস্ত্রের বিধিবিধান, রাসূল সা: জীবনী ও জীবনব্যবস্থা, আরবি ব্যাকরণ, বিভিন্ন ভাষা ও সাহিত্য অধ্যয়ন কারিকুলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্তমানে কারিকুলামের বিভিন্ন স্তর রয়েছে।
প্রাথমিক, মাধ্যমিক, স্নাতক ও মাস্টার্স (পোস্ট গ্র্যাজুয়েট)। দারুল উলুমের আইনানুযায়ী, আরবি কাসগুলোতে অংশ নেয়ার আগে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক স্তরের কৃতকার্যতা অপরিহার্য। এ স্তরে উর্দু, আরবি, হিন্দি ফারসিসহ অন্যান্য ভাষা শিায় জোর দেয়া হয়। পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্সগুলো বাধ্যতামূলক নয়। কেউ কোনো বিষয়ে বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জনের জন্য মাস্টার্স ও পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হতে পারে।
শুধু প্রাথমিক স্তরের কৃতকার্যরাই পরবর্তী ধাপ ‘হিফজে কুরআন’ অর্থাৎ কুরআন মুখস্থকরণ কোর্সে অংশ নেবে। এতে দুই থেকে চার বছর লেগে যায়। অল্প কিছুসংখ্যক কুরআনে হাফেজ কারি হাফেজগণ নির্ধারিত শ্র“তিমধুর কুরআন তিলাওয়াতের কার্যক্রমে অংশ নিতে পারেন। কিছুসংখ্যক ছাত্র পরবর্তী কোর্স ‘সাবা’ ও ‘আশারা কিরআত’ শিায় অংশ নেন। সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আট বছর মেয়াদি ফজিলত কোর্স যা ‘আরবি আউয়াল’ এর মধ্যমে শুরু হয়ে দাওরা-ই-হাদিস দিয়ে সমাপ্ত। ফজিলত কোর্স সাফল্যের সাথে সমাপ্তির পর উত্তীর্ণরা ‘মাওলানা’ খেতাবে ভূষিত হন। এ কোর্সটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিার সমতুল্য। দাওরায়ে হাদিসের শেষ বর্ষের কাস অনুষ্ঠিত হয় তাজমহলের অনুকরণে নির্মিত বৃহৎ মসজিদ রশিদের বেজমেন্টে। ২০১২-১৩ শিাবর্ষে এক হাজার ৬৩ জন ছাত্র দাওরায়ে হাদিস কোর্সে অংশ নিয়েছেন বলে জানা যায়। এ কোর্স সাফল্যের সাথে সম্পাদনকারীদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছাত্র পিএইচডি সমমানের ১৪টি বিশেষায়িত কোর্সে পড়ার সুযোগ পান। এ স্তরের উচ্চমান সম্পন্ন কোর্সগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তাক্লিম ইফতা’ (আইনতত্ত্বে বিশেষজ্ঞ), ‘তাকলিম আদাব’ (আরবি সাহিত্যে বিশেষজ্ঞ) ও ‘তাকাস্সুল ফিল হাদিস’ (হাদিস বিশেষজ্ঞ)। ‘তাক্মিল ইফতা’ কোর্সে সফলকাম ছাত্ররাই কেবল ‘মুফতি’ খেতাবে সম্মানিত হন।
হাটহাজারী মাদরাসা
হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ:-এর প্রিয় শিষ্য ও ছাত্র শাইখুল ইসলাম মাওলানা হাবিবুল্লাহ ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের পুরো নাম হচ্ছে আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম। চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত এ মাদরাসাটি ১৯০১ সালে বর্তমান হাটহাজারীতে স্থানান্তর হয়। এ প্রতিষ্ঠানটি পাক-ভারত উপমহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ শাসনে এ অঞ্চলে শিাব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও সামাজিক অবস্থা ইসলামি জীবনব্যবস্থা এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যবস্থার সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার ফলেই ইসলামি শিার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যেই এ প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। দারুল উলুম দেওবন্দের শিাপদ্ধতির অনুসরণে এ শিাপ্রতিষ্ঠানের কারিকুলাম প্রণীত হয়ে থাকে। প্রতি বছর এ প্রতিষ্ঠান থেকে শত শত আলেম-ওলামা তৈরি হয়ে থাকে। মুসলিম উম্মাহর স্বার্থ রণে এ প্রতিষ্ঠানটি নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। হাটহাজারী মাদরাসার সহায়তায় দেশের সর্বত্র হাজার হাজার মাদরাসা, মসজিদ, মক্তব ও এবাদতখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ন্যাশনাল ব্যুরো অব এশিয়ান রিসার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেওবন্দী ধারায় হাটহাজারী মাদরাসাটি শিার মান ও সুনাম অনুযায়ী উপমহাদেশের প্রধান ১০টি মাদরাসার মধ্যে অন্যতম।
কওমি মাদরাসা আন্দোলন
৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ থেকে ইসলামকে সমূলে ঊৎখাতের হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে একটি প্রভাবশালী ইসলামবিদ্বেষী মহল। ‘কওমি মাদরাসা শিা কর্তৃপ আইন ২০১৩’ নামে জাতীয় সংসদে একটি বিল পাস করার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে সরকারÑ এ অভিযোগে হেফাজতে ইসলামি বাংলাদেশের আমির শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী এবং কওমি মাদরাসার শিকসমাজের ২১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে অনুষ্ঠিত জাতীয় ওলামা মাশায়েখদের সম্মেলন থেকে এ হীন অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কিছু নতুন কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও আট দফা প্রস্তাবনা ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে : সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ঈমান ও আকিদার হেফাজত, মহান আল্লাহ ও প্রিয়নবী সা:-এর সম্মান রা; ধর্মীয় মূল্যবোধের সংরণ; সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, নৈতিক অবয় রোধ, সর্বত্র নারীর পূর্ণ নিরাপত্তা, ন্যায্য অধিকার ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করার পরিবেশ সৃষ্টির মহান ল্েয হেফাজতে ইসলাম ঘোষিত ১৩ দফা দাবি অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা। ৫ মে শাপলা চত্বরে আলেম-ওলামা ও নবীপ্রেমিক জনতার ওপর পরিচালিত গণহত্যার স্বাধীন, সুষ্ঠু বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন এবং প্রকৃত ঘটনা জাতিকে জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ও হুইপ মুফতি ওয়াক্কাসসহ আটক সব নেতাকর্মীর অবিলম্বে মুক্তি এবং সারা দেশে হাজার হাজার আলেম ওলামার বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। পশ্চিমা সংস্কৃতির আলোকে প্রণীত নারী নীতিমালার কুরআন ও সুন্নাহ তথা ইসলামবিরোধী ধারাগুলো বাতিল করে মুসলমানদের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নারী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। কওমি মাদরাসার স্বকীয়তা ধ্বংস ও সরকারের অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দেশ্যে ‘কওমি মাদরাসা কর্তৃপ আইন ২০১৩’ জাতীয় সংসদে পাস করার যাবতীয় তৎপরতা ও পদপে বন্ধ করতে হবে।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ঈমান-আমল সংরণ ও ধর্মীয় শিা-দীার প্রধান কেন্দ্র মাদরাসার ছাত্র কমানের তথাকথিত আন্দোলন সম্পর্কিত প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। দেশের অবিসংবাদিত আধ্যাত্মিক রাহবার, শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফীসহ আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও মদদপুষ্ট ব্যক্তিদের লাগামহীন কটূক্তি, মিথ্যাচার ও ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
বন্ধ করে দেয়া সব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া খুলে দেয়ার পাশাপাশি আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, মানবাধিকার সংগঠক অধিকারের সেক্রেটারি জেনারেল আদিলুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে।
দাবিগুলো আদায়ে জাতীয় ওলামা মাশায়েখ সম্মেলন ঘোষিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : কওমি মাদরাসার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ধ্বংস ও সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ল্েয ‘কওমি মাদরাসা শিা কর্তৃপ আইন ২০১৩’ বিল সংসদে পাস করার সরকারি প্রচেষ্টা অবিলম্বে বন্ধের দাবিতে ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৩ সারা দেশে একযোগে স্থানীয় জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে স্মারকলিপি পেশ, হেফাজতে ইসলামের আমির শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী ঘোষিত ১৩ দফা বাস্তবায়নের ল্েয আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে ওলামা সুধী সমাবেশ ও পেশাজীবী সংলাপের আয়োজন। আগামী ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর ২০১৩ চট্টগ্রামে দুই দিনব্যাপী ইসলামি মহাসম্মেলন, ১ ডিসেম্বর থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০১৪-এর মধ্যে প্রতিটি জেলায় শানে রিসালাত।
জঙ্গি উৎপাদনের আখড়ার অপবাদ দিয়ে বর্তমান সরকারের কেউ কেউ দেওবন্দী ধারায় পরিচালিত দেশের সব কওমি মাদরাসার শিাকে দোষারোপ করে মাদরাসা শিা সরকারি নিয়ন্ত্রণে এনে এর গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়ার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বলে মনে হয়। কওমি মাদরাসাগুলো ব্রিটিশ আমলেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের কোনো তোয়াক্কা করেনি, দেওবন্দ ও ভারত সরকারের অনেক অযাচিত বিল, আইনকানুনের বিরুদ্ধে বরাবরই বিরোধিতা করে এসেছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কওমি মাদরাসাগুলোর যাত্রা শুরু। সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে অযোগ্য অপদার্থ ইসলামবিদ্বেষী ব্যক্তিদের হাতে কওমি মাদরাসার যেকোনো দায়িত্বভার অর্পণ হবে ইসলাম ধ্বংসের প্রথম পদপে।