মাত্র ৩৬ দিনের তেল সংরক্ষণের সক্ষমতা বিপিসির
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কমার সুবিধা নিতে পারছেনা বাংলাদেশ
চীনে একবছর জ্বালানি তেলের মজুত রাখার ক্ষমতা আছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতও ছয় মাস মজুত রাখতে পারে
আন্তর্জাতিক বাজারে এখন আর কেউ জ্বালানি তেল কিনছে না। বরং বিনা মুল্যে তেল দেয়ার পাশাপাশি জ্বালানি তেল ক্রয় করলে আরো মু্দ্রা দেয়াা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের এ সুবিধা কাজে লাগাতে পারছে না বাংলাদে। কারন দেশে জ্বালানি তেল সংরক্ষণ করার সক্ষমতা নেই সরকারি সংস্থা বিপিসির।
ফলে করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম কমলেও এর ফায়দা ঘরে তুলতে পারছে না বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর মূল কারণ অতিরিক্ত জ্বালানি মজুত করে রাখার সক্ষমতা নেই সরকারি এই সংস্থাটির। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু বিশ্ব বাজারে এখন তেলের দাম কম, তাই এই সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগানো উচিত। তারা বলছেন, অর্থনীতির চাকা আবার যখন সচল হতে শুরু করবে, তখন প্রচুর জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হবে। সে সময় চাহিদা পূরণ করা কঠিন হবে। তাই এখন থেকেই মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে হবে।
বিপিসি সূত্র জানায়, দেশে যে অয়েল ট্যাঙ্কার রয়েছে তাতে মাত্র ৩৬ দিনের তেল মজুত রাখা যায়। করোনাভাইরাসের কারণে দেশে তেলের চাহিদা কমে যাওয়ায় অয়েল ট্যাঙ্কারের সবই এখন পূর্ণ রয়েছে।
জানা গেছে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আরও কিছু অয়েল ট্যাঙ্কার রয়েছে, সেগুলো ব্যবহারের কথা চিন্তা করছে বিপিসি। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেগুলোতে একবার তেল নিয়ে রেখে আসা, আবার তা ফেরত আনতে দুই দফা পরিবহন খরচ লেগে যাবে। তাছাড়া, বিদ্যুৎকেন্দ্রের এসব ট্যাঙ্কারের মজুত ক্ষমতাও কম। ফলে এই চিন্তা কতটা ফলপ্রসূ, সেটি খুব জোর দিয়ে বলতে পারছেন না বিপিসি।
বিপিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীতে এই পরিস্থিতি হবে এটি কেবল আমরা কেন, কেউ-ই চিন্তা করেনি। তিনি বলেন, আমাদের মজুত ক্ষমতা বেশি না, এ কথা সত্যি। কিন্তু এমনভাবে সারাবিশ্ব দুর্যোগের মধ্যে পড়বে আর তেলের বাজার পড়ে যাবে, এটাতো কেউ কোনও দিন ভাবেনি। এমনটি ভাবলে নিশ্চয়ই আমরা কেন পুরো দুনিয়ার তেল আমদানিকারকরা বড় বড় অয়েল ট্যাঙ্কার বানিয়ে রাখতো।
যদিও বিপিসির মজুত ক্ষমতা কম থাকার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ দিন সমালোচনা ছিল। গত কয়েক বছরে বিপিসি তাদের তেল মজুতের ক্ষমতা খুব একটা বাড়ায়নি। বেসরকারি খাতে তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের শুরুতে বিপিসি তেলের মজুত বাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য বিপিসির পাশাপাশি ওইসব কেন্দ্রের উদ্যোক্তারাও তেল আমদানি শুরু করলে বিপিসি মজুতের ক্ষমতা বৃদ্ধি থেকে সরে আসে।
বিপিসি সূত্র বলছে, তাদের ডিপোতে ৩৬ দিনের জ্বালানি তেল মজুত রাখা যায়। যদিও বিপিসির অফিসিয়াল দাবি, তারা দুই মাসের অর্থাৎ ৬০ দিনের তেল মজুত রাখতে পারে। তবে এই দাবি সঠিক নয় জানিয়ে বিপিসির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ৩৬ দিনের বাইরে আরও ছয় দিনের জ্বালানি তেল ট্যাঙ্কারে পরিবহন অবস্থায় থাকে। পরিবহন ট্যাঙ্কারের মজুতসহ ধরলেও বিপিসির তেলের মজুত ক্ষমতা ৪২ দিনের বেশি নয়।
জানা যায়, চীনে একবছর জ্বালানি তেলের মজুত রাখার ক্ষমতা আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও ছয় মাসের জ্বালানি তেল মজুত রাখতে পারে। কিন্তু দুটি দেশেই জনসংখ্যা ১৩০ কোটির কোঠায়। কিন্তু বাংলাদেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য জ্বালানি তেল মজুতের ক্ষমতা মাত্র ৩৬ দিনের।
বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ১৫ ডলারের নিচে। তবে ফিউচার মার্কেটে আগামী মে মাসের জন্য করা চুক্তিতে তেলের দাম দাঁড়িয়েছে ব্যারেল প্রতি ‘শূন্য’ ডলারেরও নিচে। সেদেশে এখন তেল নিয়ে যেতে উল্টো ক্রেতাদের অর্থ দিতেও রাজি বিক্রেতারা। দেশটিতে তেলের এতটা দরপতন আর কখনও হয়নি। গত মাস থেকে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ২০ ডলারে নেমে যায়।
গত বছর (২০১৯) বিপিসি পরিশোধিত-অপরিশোধিত মিলিয়ে ৫৩ লাখ ৯৪ হাজার ৬২৮ মেট্রিক টন জ্বালানি তেল আমদানি করে। এরমধ্যে পরিশোধিত জ্বালানি তেলের পরিমাণ ৪২ লাখ ২৮ হাজার ২০০ মেট্রিক টন এবং অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন। এবার করোনার কারণে তেলের ব্যবহার কিছুটা হলেও কমে আসবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ শামসুল আলম বলেন, ‘এই সুবিধা এখন বিপিসি নিতে পারবে না। কারণ, তাদের বেশি দিন মজুতের সুযোগ নাই। তারপরেও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে তেলে কিনে মজুত করে। তাদের সঙ্গে নিয়ে এই সময়ে মজুত বাড়ানো দরকার। দাম কমে যাওয়ার পুরো সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করা দরকার।’ তিনি বলেন, ‘স্থায়ী আর্থিক সক্ষমতা গড়ে তোলা দরকার। এতে কোম্পানিগুলো নিজেরাই সক্ষম হবে। সব সময় দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজনে কমাতেও পারবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ম. তামিম বলেন, ‘যতটা পারা যায় মজুত করতে হবে। যেখানে যতটুকু করা সম্ভব খুঁটিনাটি হিসাব করেই মজুত করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যখন আবার অর্থনীতির চাকা সচল হতে শুরু করবে, তখন কিন্তু প্রচুর জ্বালানি তেলের প্রয়োজন হবে। সে সময় চাহিদা পূরণ করা কঠিন হবে। তাই এখন থেকেই মজুত বাড়ানোর পরিকল্পনা করতে হবে।