ইংল্যান্ডের প্রবীন আলেম ড. মাওলানা খালেদ মাহমুদের ইন্তেকাল

ফরহাদ খান নাঈম: দারুল উলুম দেওবন্দের মায়েনাজ ফাজিল, শাইখুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মাদানি রহমাতুল্লাহ আলাইহির সুযোগ্য সাগরেদ হজরত মাওলানা ড. খালেদ মাহমুদ গত বুধবার রাতে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন ভারতের অম্রিতসারের বাসিন্দা। তবে তিনি জন্মগ্রহণ করেন লাহোরের কাসুর জেলায়। শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া, শায়খুল ইসলাম মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী, মাওলানা বদরে আলম এবং মাওলানা শামসুল হক আফগানী রহ. এর মতো সমসাময়িক বড় বড় ইসলামী পণ্ডিতের কাছ থেকে তাঁর শিক্ষালাভের সুযোগ হয়। তিনি সাইয়েদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী, মাওলানা আহমদ আলী লাহোরী এবং হাকিমুল ইসলাম ক্বারি মুহাম্মদ তৈয়ব সাহেব রহ. এর মতো বিখ্যাত মাশায়েখের সাহচর্য লাভে ধন্য হন।

ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ফারসি ও আরবি ভাষাসহ জ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও বুৎপত্তি অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৩০ সালে তিনি শিয়ালকোটের মুররাই কলেজে অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে শিক্ষকতার জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি লাহোরের এমএও কলেজে অধ্যাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত হন। এরপর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর পদে নিয়োগ পান।
আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. তানযিমে আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাতে যোগদান করেন, এবং বহু বছর যাবত উক্ত সংগঠন থেকে প্রকাশিত “দাওয়াত” নামক ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালেখি করেন। তিনি তাঁর লেখায় সাধারণত জীবনঘনিষ্ঠ বিভিন্ন জটিল বিষয়ে মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতেন। যেগুলো পরবর্তীতে সংকলন করে “আবকাত” নামক একটি বইরূপে প্রকাশ করা হয়।
১৯৬০ সালে আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. যুক্তরাজ্যে চলে আসেন এবং বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পিএইচডি সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ম্যানচেস্টারে আসেন, এবং সেখানে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে তিনি স্থানীয় অন্যান্য উলামাদের সাথে একত্রিত হয়ে জমিয়তুল উলামা ব্রিটানিয়া নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন; যেটির উদ্দেশ্য ছিলো মুসলমানদের সার্বিক সমস্যার সমাধান করা ও তাদেরকে দ্বীনের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ করে তোলা।
তার স্মরণীয় কর্মসমূহ:
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের শরীয়াহ আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন। খ্রিষ্টান, শিয়া, কাদিয়ানি, বেরলভী ও আহলে হাদীস পন্থীদের সাথে বহু জটিল বিতর্কে তিনি চমৎকার সাফল্য প্রদর্শন করেন। ফলে সারা বিশ্বে তাঁর বাগ্মিতার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি অত্যন্থ অল্প বয়স থেকেই বিতর্ক শুরু করেন। মাত্র পনেরো বছর বয়সে এক কাদিয়ানি গ্রুপের সাথে তিনি বিতর্কে অংশ নিয়ে জয়লাভ করেন।
তাঁর কিছু বিখ্যাত বিতর্কের মধ্যে রয়েছে:
ক. তাকিয়ার উপর ইরানের ক্ষমতাসীন মুজতাহিদের সাথে বিতর্ক;
খ. নাইজেরিয়ায় কাদিয়ানিদের সাথে বিতর্ক;
গ. ১৯৭৯ সালে যুক্তরাজ্যে শিফিল্ডে বেশ কয়েকজন সিনিয়র বেরলভী নেতার সাথে বিতর্ক।
আল্লাহ তা’য়ালা তাঁকে এসব বিতর্কে সাফল্য দান করেন। এবং তাঁর বিরোধীরা লজ্জিত হয়ে প্রত্যাবর্তন করে। তৎকালে কেইপটাউন থেকে কাদিয়ানিদের অপসারণেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো।
আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. তাঁর অনন্য দূরদৃষ্টি, গভীর চিন্তাশক্তি ও তীক্ষ্ণ ধীশক্তির জন্য অত্যন্ত বিখ্যাত ছিলেন। আল্লাহ তা’য়ালা তার স্মৃতিশক্তিতে এতো পরিমাণে বরকত দান করেছিলেন যে, তিনি অসংখ্য কিতাব থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিতে পারতেন।
তাঁর এই কর্মময় জীবন তাঁকে কখনোই ধর্মপালনে বিমুখ করতে পারেনি। শত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ইসলামের প্রতিটি অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। তিনি তাঁর গোটা জীবন দ্বীনের সেবায় বিলিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সাল থেকে তিনি ম্যানচেস্টারে সাপ্তাহিক দারসুল কুরআনের ক্লাস পরিচালনা করে আসছিলেন। তাঁর উক্ত দারসে অসংখ্য মুসলমান নিয়মিত অংশগ্রহণ করে তাঁর মুখনিঃসৃত মূল্যবান বানী থেকে উপকৃত হতেন।
তাঁর সাহিত্যকর্ম:
আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. প্রায় ১০০ টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। দশ ভলিউমে সম্পন্ন তাঁর লিখিত বিখ্যাত কিতাব হলো:
মুতালিয়ায়ে বেরলিয়্যাত; আছারুত তানজিল (তাফসীর গ্রন্থ) ; আছারুল হাদীস; আছারুত তাশরীহ (ফিকহ গ্রন্থ);
আছারুল ইহসান (তাসাউফ বিষয়ক গ্রন্থ)। এগুলোর প্রত্যেকটিই দুই ভলিউমে সম্পন্ন হয়েছে। উল্লিখিত গ্রন্থগুলোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর উপর বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। এই গ্রন্থগুলো আলেমগণ তাদের গবেষণার কাজেও ব্যবহার করে থাকেন।
তাঁর লেখা অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে:
চার ভলিউমে সম্পন্ন হওয়া মুতালিয়ায়ে কাদিয়ানি, মাক্বামে হায়াত, খোলাফায়ে রাশেদীন, আবকাত, মা’ইয়ারে সাহাবিয়্যাত, শাহ ইসমাইল শহীদ রহ., তাজাল্লিয়াতে আফতাব ইত্যাদি। এছাড়াও আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. এর বিখ্যাত বিতর্কসমূহও গ্রন্থাকারে পাওয়া যায়। সাইয়েদ আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহ. খতমে নবুওয়াতের উপর তাঁর সাহিত্যকর্মের ভূয়সি প্রশংসা করেন।
তাঁর ব্যাপারে বলা হতো, যদি আসরের সময় কোনো ফিতনা দেখা দেয়, তাহলে মাগরিবের আগেই আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. (বিতর্কের মাধ্যমে) তা নিঃশেষ করে দিতে পারেন। তাঁর ব্যাপারে মুফতি জর ওয়ালি খান সাহেব বলেন, আল্লামা খালিদ মাহমুদ রহ. ছিলেন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আদর্শের সর্বশ্রেষ্ঠ ধারক ও তাঁর সময়কার শ্রেষ্ঠ আলেম।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button