মা-গো ভাবনা কেন?
মম কাজী: বিশ্ব মা দিবসের এই হুজুগটা আমার বেশ ভালই লাগে।এই সুযোগে সকল আন্টিদের ছবি দেখতে পাওয়া যায় ফেইসবুকে। মায়ের জন্য বিশেষ কিছু করা কিংবা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা যায় এই দিনের মধ্য দিয়ে।যদিও “মা দিবস” বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারি না। মায়ের আবার দিবস কি? মা তো মা-ই। আজকেও মা, কালকেও মা, পরশুদিনও মা বাঙালির জন্য “মা দিবস” অন্য যে কোনও পশ্চিমী দিবসের মতই আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিছুই না। তবে হ্যা তথাকথিত পশ্চিমী সমাজে “মা দিবসের” প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। যখন ১৮ বছরের পরেই সন্তান মায়ের বাসা ছেড়ে নিজের জীবনের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়, তখন “মা দিবসের” বদৌলতে সেই বেরিয়ে যাওয়া ছানারা মাকে দেখতে উপহার নিয়ে আসে। আর প্রবীন মায়েরা যখন বৃদ্ধাশ্রমে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করেন তখন এই “মা দিবস” সন্তানদের টেনে নিয়ে আসে একবেলা একসাথে খাওয়ার জন্য।
তবে বাঙালীর “মা দিবসের” অর্থ ও তাৎপর্য কিন্তু ভিন্ন। আমরা হলাম চিরজীবন মায়ের আচঁল ধরা পদ। সারাটা জীবন, বিশেষ করে ছেলেরা মায়ের উপর নির্ভরশীল। আর আমাদের মায়েরাও আহ্লাদ করে শিকেয় তুলে আমাদের লালন করেন বুড়ো হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু, বাংলা সিনেমা এবং বিখ্যাত অনবদ্য অভিনেত্রী শাবানার বদৌলতে “মা” প্রসঙ্গে আমরা বাঙালিরা খুবই স্পর্শকাতর। মায়ের সম্পর্কে প্রতিটা কথা, প্রতিটা সাহিত্য, প্রতিটা লেখার মধ্যে ফুটে ওঠে কষ্ট আর বেদনা।মায়ের সাথে সবচেয়ে বেশি ব্যাবহৃিত বিশেষণ হচ্ছে “জনমদুখি মা”। আচ্ছা মায়ের সাথে দু:খের এত নিবীড় যে সম্পর্ক তা কি সন্তান হিসেবে আমাদের লজ্জার সবচেয়ে বড় কারন না? আমরা থাকতে মায়ের দু:খ থাকে কিভাবে?
এটা তো চিরসত্য,মা হল সবচেয়ে আপনজন। আর আমরা মাকে মা-ই দেখি, এটা খুব কম সময়ে চিন্তা করি, মা কিন্তু একজন মানুষও বটে। মনে করি না যে, আমার মা টাও এক সময়ে বাচ্চা একটা মেয়ে ছিলেন। ফ্রক পড়ে স্কুলে যেতেন, বন্ধুদের সাথে দৌড়ে খেলে ব্যাথা পেয়ে তাঁর মায়ের কাছে বকুনি খেতেন, হয়ত বোরিং ক্লাসে স্বপ্নে বিভোর হতেন কোনও রাজকুমারের, হয়ত নিজেই লজ্জা পেয়ে লাল হতেন। হয়ত বাবা নামক ব্যাক্তিটিকে চিনতেনও না বিয়ের আগে। হয়ত পরম ভালোলাগায় ছুঁয়ে দেখতেন তাদের ভালোবাসাবাসির প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ফুল এই আমাদের। হয়ত আমরা এসে তার জীবনের সকল পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছি, হয়ত আমরা এসেছি সামাজিক ও পারিবারিক চাপ থেকে আবার হয়ত বহু বছরের সাধনার ধন এই আমরাই। তবে কারন যাই হোক, যখন আমরা এসেছি তখনই সেই ছোট্ট মেয়েটার আর একটা পরিচয় হয়েছে। আর তা হল সে একজনের মা। সে আমার মা।
বইএর উইপোকা হিসেবে বিশ্বের বহু সাহসী নারীর জীবনি আমি পড়েছি। ম্যারী কুরী থেকে নিয়ে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এবং আজকের মালালা…. সকলেই নারী। তবে এই সকল নারীদের মধ্যে আমার জানা সবচেয়ে সাহসী নারী হলেন আমার মা। জীবন তাকে একহাতে যেমন ঢেলে দিয়েছে তেমনি অন্যহাতে দিয়েছে নানা রকম চ্যালেন্জ। আমি নিজেই একটা চ্যালেন্জের চেয়ে কোনও অংশে কম না। আমি দেখেছি তাকে ভয় পেতে। আতঙ্কে নিদ্রাহীন রাতের পর রাত কাটাতে। কিন্তু সেই ভয় বুকে নিয়েই সে অতিক্রম করেছে অসম্ভব সকল পথ। আমার বন্ধুরা আমাকে যখন সাহসী বলে তখন আমি বলি, আমার মায়ের কাছে আমি কিছুই না।
মা খুব এডভেন্চার খুব পছন্দ করেন। তা দেশ বিদেশ বেড়ানো হোক কিংবা নতুন কোনও ব্যবসা করা হোক। তিনি একপায়ে খাড়া। যদিও সবাই তাকে “উড়নচন্ডি” বলেন কিন্তু তিনি তার মত করে নিজের জন্য ছোট ছোট এডভেন্চার তৈরী করেই রাখেন। আর একটা ব্যাপারে না বললেই নয়, কোনও জিনিসের সর্বোচ্চ ব্যবহার আমার মায়ের মত কেউ করতে পারে না। যেমন ধর, তিনি একটা শাড়ি কিনলেন, সেই শাড়ি পুরাতন হয়ে গেলে সেটা কেটে আমার জন্য জামা বানাবেন। জামা পুরাতন হলে আমার ছোট বোনদের জন্য ফ্রক। তা পুরাতন হলে রান্নাঘরের লুসনি এবং ঘর মোছার ন্যাকড়া। এরমাঝে এক টুকরা সরিয়ে রাখবেন যেন চোখের কাজল বানাতে পারেন। নিন্দুকেরা যদিও “কিপটা” বলবেন তবে বাবাবিহীন এক পরিবারের সাময়িক ভেসে থাকার জন্য এই কিপটা মানুষটারই অবদান ছিল। যারা নামটা দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে থেকে কেউ আসেনি বাসার গ্যাসের বিল দিতে। আমি এখনও তাঁর এই মতাদর্শে চলি।
পৃথিবীর সবার মাই সবার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ জন।মা হিসেবে তাদের অবদানের কথা কেউই লিখে শেষ করতে পারবে না। তবে ইদানীং আমি মা কে মানুষ হিসেবে দেখতে চেষ্টা করছি।আমাদের মধ্যে সাধারন মা-মেয়ের সম্পর্ক কখনই ছিল না। ইংরেজীতে এর একটা নাম আছে- “frenemy” (friend+enemy) যেখানে আমরা সেই বন্ধু যারা একে অপরকে বিস্তর ভালোবাসব তো বটেই তবে দোষ ধরতেও ছাড়ব না।
আমার মা “জনমদুখী” নন। তিনি “জনমদুখী” হওয়ার সকল উপকরণ হাতে পেয়েও নিজ সিদ্ধান্তে নিজেকে একজন সুখী মানুষে পরিনত করেছেন। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং কারও উপরে নির্ভর করে দিনাতিপাত করেন নি।নিজেকে আনন্দে হাসিতে ভরিয়ে রেখেছেন।
আমার কাছে মাদার টেরেসা, এমিলিয়া এয়ারহার্ট কিংবা মিশেল ওবামার চেয়েও আমার মা একজন বড় হিরো। ১৪ বছর আগে একজনকে বলেছিলাম, আমি আমার মায়েরাই মেয়ে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে যদি একটুখানিও মায়ের মেয়ে হতে পারতাম তবে জীবন স্বার্থক হত।
লেখিকা: কানাডা প্রবাসী সমাজ কর্মী