বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয় বাংলাদেশ
করোনা আতঙ্কে দেশের মানুষ যখন আতঙ্কিত, মানুষ যখন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত তখন দেশের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনছে মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। এ বিভাগের পূর্বাভাস বলছে, চলতি অর্থবছর (২০১৯-২০) চাল উৎপাদন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্য দিয়ে ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ স্থানটি ধরে রাখতে উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদে যেতে হবে। কৃষককে উপকরণ দিয়ে আরও বেশি সাপোর্ট দিতে হবে।
দেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেড়েছে চালের উৎপাদন। দীর্ঘদিন ধরেই খাদ্যশস্যটি উৎপাদনে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার দখলে। তবে এবার ইন্দোনেশিয়াকে সরিয়ে সেই অবস্থানে উঠে আসছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর আমন মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। আবার গত আউশ মৌসুমেও চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফলই বাংলাদেশ শীর্ষ তিনে চলে আসার মূল কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চাল উৎপাদনে তৃতীয় স্থান অধিকারের বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য, সিনিয়র সচিব ও কৃষি অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সুখবর। দেশে চালের উৎপাদন প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এরপরও আমাদের জনসংখ্যার চাপ এত বেশি যে, এখনো আমরা চাল আমদানিকারক দেশ। প্রতি বছর ৫০-৫৫ লাখ মেট্রিক টন চাল আমাদের আমদানি করতে হয়। চাল উৎপাদন আরও বেশি বাড়িয়ে এটা ধরে রাখতে হবে। আমাদের অনেক দূর যেতে হবে। সম্পূর্ণভাবে চাল রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিণত হতে হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে জমি আছে সে জমি দিয়েই আরও অধিক ফসল ফলানো সম্ভব। এ জন্য আমাদের আধুনিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক চাষাবাদে যেতে হবে। কৃষককে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
কৃষি সচিব মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, ‘এ কৃতিত্ব কৃষকের। এছাড়া আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কৃষিমন্ত্রীও কৃতিত্বের অধিকারী। কারণ ডিএপি সারের দাম কমানো হয়েছে বলে এর সুফল পেলাম। দাম কমানোর ফলে কৃষক ভালোভাবে বোরো ফসলে সার ব্যবহার করতে পেরেছেন।’
তিনি বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়াকে টপকে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এর মধ্য দিয়ে আমরা খাদ্য নিরাপত্তায় এক ধাপ এগিয়ে গেলাম। এ কৃতিত্ব ধরে রাখতে হবে। আগামীতে ফলন আরও বাড়াতে হবে। এজন্য প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। তাহলে আমরা এ স্থানটি ধরে রাখতে পারব।’
ইউএসডিএর প্রতিবেদনের তথ্যমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে সারাবিশ্বে ৫০ কোটি ২০ লাখ টন ছাড়াতে পারে চালের উৎপাদন, যা গত অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ বেশি। চীন সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদন করবে। দেশটি চলতি অর্থবছর ১৪ কোটি ৯০ লাখ টন চাল উৎপাদনের মাধ্যমে শীর্ষে অবস্থান করবে। এরপরই রয়েছে ভারত। তাদের চাল উৎপাদন দাঁড়াবে ১১ কোটি ৮০ লাখ টন। এর পরই ৩ কোটি ৬০ লাখ টন উৎপাদন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসবে বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন ধরেই তিন নম্বরে থাকা ইন্দোনেশিয়া এবার চতুর্থ অবস্থানে নেমে যাবে। দেশটিতে চালের উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৪৯ লাখ টন।
দীর্ঘদিন ধরেই খাদ্যশস্যটি উৎপাদনে বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল চতুর্থ। চীন ও ভারতের পরই তৃতীয় স্থানটি ছিল ইন্দোনেশিয়ার দখলে। তবে এবার ইন্দোনেশিয়াকে সরিয়ে সেই অবস্থানে উঠে আসছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছর আমন মৌসুমে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছে। আবার গত আউশ মৌসুমেও চালের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন মৌসুমে উৎপাদন বৃদ্ধির সম্মিলিত ফলাফলই বাংলাদেশ শীর্ষ তিনে চলে আসার মূল কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো ধান থেকে। বাকিটা আসে আউশ ও আমন থেকে। দেশে একই জমিতে বছরে তিনবার ধান উৎপাদন করা হয়। বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা ধান চাষের আওতায় আনা হচ্ছে। এ অঞ্চলের উপযোগী ধানের জাত সম্প্রসারণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। চলতি মৌসুমে হাওড় এলাকায় ধানের বাম্পার ফলনের মাধ্যমে দেশের চালের উৎপাদনে একটি বড় পরিবর্তন আসতে পারে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এবার চাল উৎপাদনের শীর্ষ ১২টি দেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পরই থাকছে ভিয়েতনাম। দেশটিতে এবার উৎপাদন দাঁড়াবে দুই কোটি ৭৫ লাখ টন। এছাড়া থাইল্যান্ডে দুই কোটি চার লাখ টন, মিয়ানমারে এক কোটি ৩১ লাখ টন, ফিলিপাইনে এক কোটি ১০ লাখ টন, জাপানে ৭৬ লাখ ৫০ হাজার টন, পাকিস্তানে ৭৫ লাখ টন, ব্রাজিলে ৬৯ লাখ ও কম্বোডিয়ার প্রায় ৫৮ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে। ইন্দোনেশিয়া চলতি বছর খারাপ পরিস্থিতির কারণে উৎপাদন ধরে রাখতে পারেনি। তবে সামনের বছরে দেশটি ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তখন বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় স্থান ধরে রাখাটা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘এটা জাতির জন্য অনেক বড় অর্জন। দেশে যে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে এটা তারই প্রমাণ। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ধারাবাহিকতার কারণেই আমরা পঞ্চম থেকে চতুর্থ এবং চতুর্থ থেকে আজ তৃতীয় স্থানে অবস্থান নিতে যাচ্ছি। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে আনন্দে আমার বুকটা ভরে গেছে। এটা খুবই বড় অর্জন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইন্দোনেশিয়া অনেক বড় দেশ। তাদেরকে পেছনে ফেলাটা একটা বড় বিষয়। এই স্থানটা ধরে রাখাও বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা ‘রাইস ভিশন ২০৫০’ প্রণয়ন করেছি এবং সে টার্গেট অনুযায়ী এগিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশে আর কখনো খাদ্য সংকট হবে না, দুর্ভিক্ষ হবে না।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক কৃষিবিদ ড. আবুল কালাম আযাদ এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশকে এক সময় তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো। সেখান থেকে আজ খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ। এটা অভাবনীয় সাফল্য। এই সাফেল্যের পেছনে ম্যাজিক্যাল কিছু নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সব কৃষি বিভাগের কর্ম পরিকল্পনা এবং কৃষকদের কৃষি উপকরণের যোগান দেওয়াটা ভালো কাজ হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন। যেমন বোরোর আগে সারের দাম কমানোটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের বিভিন্ন টেকনোলজিক্যাল সাপোর্ট ও পরিকল্পনা ধান প্রডাকশনকে এগিয়ে নিয়েছে। কৃষির ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন তার কন্যা শেখ হাসিনা সেই নীতি অনুসরণ করেছেন। সে কারণেই এ সাফল্য।