যুক্তরাজ্যে প্রদীপের নিচে অন্ধকার: বঞ্চিত গ্রেনফেলের প্রতিকার হয়নি বরং গোটা ‘বেইম’ কমিউনিটি এখন পরিত্যক্ত
থমাস কিংসলে: রোববার সন্ধ্যায় লন্ডনজুড়ে গীর্জার ঘন্টাগুলো একসাথে বেজে ওঠে গ্রেনফেল অগ্নিকান্ডের তৃতীয় বার্ষিকী স্মরণে। এই অগ্নিকান্ড ৭২ জন মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিলো। অনেকের মতে অগ্নিকান্ডটি বর্ণ ও শ্রেণীগত বৈষম্যের ফল। আজ এর তিন বছর পর, একই বৈষম্যের বিষয়টি প্রকাশিত হয়েছে যখন সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, কৃষ্ণাঙ্গ, এশীয় ও সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক (বেইম) পটভূমির লোকজনের কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃত্যুর ঝুঁকি শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ জনগণের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশী।
বেইম লোকজনের ওপর করোনা ভাইরাসের অনানুপাতিক অর্থাৎ অসম প্রভাবে আশ্চর্য হবার তেমন কিছু নেই। তবে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, তিন বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকার গ্রেনফেল থেকে কোন শিক্ষা নেয়নি। কেনসিংটন এন্ড চেলসি হচ্ছে লন্ডনের অন্যতম ধনী বারা। নর্থ কেনসিংটন-যেখানে গ্রেনফেল টাওয়ার এখন একটি স্মৃতিসৌধ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে বারার অন্যান্য স্থানের তুলনায় দ্বিগুণ সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয় লোকজনের বসবাস। এটা বিশ্বাসের নয় অতীত যে, যুক্তরাজ্যের কিছু সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও প্রাচুর্যপূর্ণ রাস্তাঘাট সম্বলিত এই বারায় একটি ২৪ তলা বিশিষ্ট শত ব্লকের একটি হাউজিং উচ্চ দাহ্যতা সম্পন্ন সামগ্রীতে ঢাকা থাকবে, যা ৭২ জন মানুষের মৃত্যুর কারণ।
ট্রাস্ট ফর লন্ডন, অনুসারে নর্থ কেনসিংটনে গড়পড়তার চেয়ে বেশী দারিদ্র্যের হারও শিশু দারিদ্র্য বিদ্যমান। কর্মহীনদের বেনিফিট গ্রহণকারীদের সংখ্যাও এখানে গড়পড়তার চেয়ে বেশী। জাস্টিস ফোর গ্রেনফেল -এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইভেট উইলিয়ামসের প্রশ্ন: একটি ভিন্ন ভৌগলিক অঞ্চল থেকে আসার কারণেই গ্রেনফেল ভিকটিমদের এমন ভিন্ন ভাগ্যলিপি বরণ করতে হবে?
আমি মনে করি, তা হতে পারে।গ্রেনফেল অগ্নিকান্ড কোন শূণ্যতায় সংঘটিত হয়নি।উইন্ডরাশ প্রজন্মসহ বর্ণভেদকৃত অভিবাসীদের ওপর বহু দশকের বৈষম্যের ফল এটা, যে বৈষম্যের ফলে যুক্তরাজ্যে প্রবেশ পর তাদেরকে নর্থ কেনসিংটনের বস্তি এলাকায় বসবাসে বাধ্য করা হয়। এই বর্ণবাদী বৈষম্য প্রতিধ্বনিত গ্রেনফেলে। এর বাসিন্দারা উপর্যুপরি ভবনটির নিরাপত্তা বিষয়ে উদ্বেগ ব্যক্ত করা সত্বেও তাতে কর্ণপাত করা হয়নি। এমনকি বর্তমানেও ৭টি পরিবার অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে।
গ্রেনফেলের পর পরই সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে প্রতিশ্রুতি দেন যে, এটা থেকে শিক্ষা গ্রহণ হবে এবং শোকাবহ ঘটনাটির ব্যাপারে তদন্ত করা হবে,’কোন কিছুই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না’। কিন্তু তদন্তটি যা ২০১৭ সালে চালু করা হয়, এতে এসব বিষয়ে শিক্ষার প্রতি সরকারের ব্যর্থতার আশু চিহ্ন লক্ষ্য করা যায়। মে’র প্রতিশ্রুতি সত্বেও বিষয়টি গুরুত্বহীনতায় পর্যবসিত হয়, যখন বর্ণবাদী ও শ্রেণী বৈষম্যের বিষয়টি তদন্ত থেকে বাদ দেয়া হয়।
গ্রেনফেল তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী এসব বিষয় তদন্তের পরিধিরও বাইরে বর্ধিত করতে এবং এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষায় সম্মত, যা একটি বিচারকের নেতৃত্বধীন তদন্তের জন্য উপযুক্ত নয়।’
এর জবাবে কেনসিংটনের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দা ও জাস্টিস -ফোর- গ্রেনফেলের উইলিয়ামস বলেন: গ্রেনফেলের লোকজন এই কাহিনীর হৃদপিন্ডে অবস্থান করছে ।অতএব বর্ণ ও শ্রেণীগত বৈষম্য বাদ দিয়ে এই কাহিনী পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না।
প্রশ্ন জাগতে পারে, বেইম জনগণের ওপর বর্ণ ও শ্রেণী বৈষম্যের প্রভাব মূল্যায়ন কখন উপযুক্ত হতে পারে? ৭২ জন লোকের বেদনাদায়ক মৃত্যু এবং একটি বিত্তশালী বারার সবচেয়ে বঞ্চিত এলাকায় একটি সোশ্যাল হাউজিংয়ে অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয় নৃতাত্ত্বিক লোকজন বসবাস করলেও যদি না হয়, তবে কখন?
এক পর্যায়ে জনগণের প্রতি আহবান জানানো হয়েছিলো যথাসম্ভব তাদের বাড়িঘরে অবস্থানের জন্য। সর্বশেষ সরকারী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখনো সেখানে গ্রেনফেল ধরণের ৩০০ টি হাইরাইজ বিল্ডিং রয়েছে।
গত বছর কমিউনিটি মন্ত্রী জেমস্ ব্রোকেন শায়ার বলেন, এ মাসেই এ ধরণের ক্ল্যাডিং অপসারণ করা হবে। কিন্তু সরকার তার সময়সীমা মানেনি। গ্রেনফেলের পর ৩ বছর অতিবাহিত হয়েছে, এখনো হাজার হাজার গৃহস্থালীকে সম্পত্তিসমূহে অবস্থান করতে হচ্ছে, যেগুলো গ্রেনফেলের মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করতে পারে যদি কোন অগ্নিকান্ড ঘটে।
গ্রেনফেল থেকে আজ অবধি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি সামান্যই পরিবর্তিত হয়েছে এবং যেহেতু এবছরের গ্রেনফেল বার্ষিকী দেশব্যাপী ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ (কৃষ্ণাঙ্গ জীবণ গুরুত্বপূর্ণ) শীর্ষক বিক্ষোভের মধ্যে পড়েছে, তখন সরকারের সদস্যদের মুখ থেকে এই শ্লোগানটি শোনা হাস্যকর প্রতীয়মান হচ্ছে। কৃষ্ণাঙ্গদের জীবণ সরকারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না যতক্ষণ না গ্রেনফেলে এবং এখন করোনাভাইরাসে বেদনাদায়কভাবে প্রকাশিত বর্ণ ও শ্রেণীগত বৈষম্যসমূহের প্রতিকারে পদক্ষেপ গ্রহন করা হয়।