প্রতারণার বিষয়টিকে ইতালীর সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে
করোনার ভুয়া সনদ: বিদেশে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত ইমেজ
করোনা টেস্টের জালিয়াতিই কাল হলো ইতালিতে ফেরা প্রবাসীদের
রিজেন্টসহ বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা পরীক্ষার নামে প্রতারণা ও ভুয়া রিপোর্ট দেয়ার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের ইমেজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোনো কোনো দেশ এরই মধ্যে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেও শুরু করেছে। দেশগুলো একদিকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বের করে দিচ্ছে, অন্যদিকে বৈধ কাগজপত্র ও ওয়ার্ক পারমিট থাকা সত্ত্বেও ঢুকতে দিচ্ছে না বাংলাদেশিদের।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানানো হয়েছে, সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে ইতালী। গত বুধবার কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট ১২৫ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে দেশটিতে যাওয়ার পর সেদেশের সরকার বাংলাদেশিদেরই শুধু নামতে দেয়নি, বিমানটিকেও ফিরিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া এবং বাংলাদেশিদের বহনকারী অন্য সকল দেশের বিমানের অবতরণও ইতালীতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে এক সপ্তাহের জন্য নিষিদ্ধ করা হলেও জনগণের পক্ষ থেকে কয়েক বছর নিষিদ্ধ রাখার ব্যবস্থা নেয়ার জোর দাবি উঠেছে।
এর কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে ইতালীর গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, বাংলাদেশে গোপনে টাকার বিনিময়ে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। এ ধরনের রিপোর্ট নিয়ে ইতালীতে আগত অনেক বাংলাদেশির দেহেই করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে। অথচ করোনা নেগেটিভ মর্মে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া রিপোর্ট দেখিয়ে ওইসব বাংলাদেশি ইতালীতে চাকরিতে ঢুকেছিল। সন্দেহ দেখা দেয়ায় তাদের আবারও পরীক্ষা করা হয়েছে এবং প্রমাণিত হয়েছে, তারা আসলে করোনা রোগী। প্রতারণার এ বিষয়টিকে ইতালীর সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমলে নিয়েছে। দেশটির গণমাধ্যমেও বাংলাদেশকে নিয়ে নিন্দা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। ইতালীতে বাংলাদেশিদের চাকরি ও প্রবেশ করতে না দেয়ার দাবি জানিয়েছে সকল মহল।
আমরা বাংলাদেশ বিরোধী অমন মনোভাব, সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমকে অত্যন্ত আশংকাজনক মনে করি। কারণ প্রথমত, সংখ্যার দিক থেকে যতো কম আর বেশিই হোক না কেন, ইতালীতে অনেক বাংলাদেশি চাকরিতে নিয়োজিত রয়েছে। তারা চাকরি করছে বহু বছর ধরেই। তাছাড়া রফতানি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষেও অনেক বাংলাদেশিকে ইতালীতে যাতায়াত ও বসবাস করতে হয়। এখন করোনা পরীক্ষায় জালিয়াতির কারণে বাংলাদেশি মাত্রের জন্যই ইতালীর দরোজা বন্ধ হয়ে যাবে।
উদ্বেগের দ্বিতীয় কারণটিও যথেষ্ট ভীতিকর। ইতালীর বাংলাদেশ বিরোধী সিদ্ধান্ত ইউরোপ-আমেরিকার অন্য দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলবে। সেসব দেশও বাংলাদেশিদের চাকরি ও প্রবেশ করতে দেয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি তো করবেই, ইতালীর মতো কঠোর ব্যবস্থাও নিতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের ইমেজই কেবল নষ্ট হবে না, রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়সহ অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতিও কল্পনার সীমা ছাড়িয়ে যাবে।
অমন আশংকার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশের সচেতন সকল মহলের পক্ষ থেকে জালিয়াত চক্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে। আমরাও মনে করি, বিশেষ করে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিকসহ অন্তত কয়েকজনের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়া হলে এবং এ বিষয়ে ইতালীর পাশাপাশি ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোকে অবহিত করা হলে বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে। সরকারকে একই সঙ্গে করোনা পাসপোর্ট প্রবর্তনের মতো এমন কিছু বিশেষ পদক্ষেপও নিতে হবে, যাতে বাংলাদেশের ব্যাপারে আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়। এ উদ্দেশ্যে সরকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের যুক্ত করতে পারেÑ যারা পাসপোর্ট তৈরি থেকে বিদেশে যাওয়া পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষক হিসেবে অংশ নেবেন এবং এই মর্মে সত্যায়ন করবেন যে, পাসপোর্ট গ্রহণকারী ও বিদেশগামীদের স্বাস্থ্য সঠিকভাবেই পরীক্ষা করা হয়েছে।
আমরা মনে করি, বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই সরকারের উচিত তৎপর হয়ে ওঠা। ইতিমধ্যে চিহ্নিত ও প্রমাণিত প্রতারকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা তো নিতেই হবে, একই সঙ্গে ইতালীসহ সকল দেশের সঙ্গেও সরকারকে কূটনৈতিক পন্থায় সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে উদ্যোগী হতে হবে। একথা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, বিষয়টির সঙ্গে দেশের ভাবমর্যাদা শুধু নয়, অর্থনৈতিক স্বার্থও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। সুতরাং বেশি বিলম্ব করার ফল বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে।