কার সততায় বিশ্বাস রাখবে ফিলিস্তিন

মানুষের জনপদে মানুষকে সম্মান করতে হয়। মানুষ মর্যাদাবান সৃষ্টি; মানুষ অবদমনের পাত্র নয়, ক্রীতদাসও নয়। মানুষের স্বাধীন সত্ত্বাকে মেনে নিতে হয়, কারণ স্বয়ং স্রষ্টা মানুষকে এই স্বাধীনতা দিয়েছেন। অথচ বর্তমান সভ্যতায় মানুষ নানাভাবে বন্দী, বন্দী কত জনপদ, কত রাষ্ট্র! বন্দীদশার আছে নানা রূপ, নানা মাত্রা। অর্থাৎ বর্তমান সভ্যতা সব মানুষের সব জনপদের এবং সব রাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে সমর্থ হয়নি। শক্তিমান রাষ্ট্রগুলো সংঘ, সংগঠন, প্রতিষ্ঠানের নামে নানা কৌশলে, নানা উত্তাপে মানুষের, জনপদের ও রাষ্ট্রের অবমাননা করে চলেছে। এমন অবমাননার সবচাইতে বড় শিকার ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীরা! ফিলিস্তিনীরা এখনো তাদের মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। তবে সভ্যতার শাসকরা তাদের বিপর্যস্ত করার সব কৌশল নির্মমভাবে প্রয়োগ করে চলেছে। আরবদের ঐক্যে ভাঙন ধরাবার প্রচেষ্টায় ওদের নেই কোনো ক্লান্তি। শান্তি আর শান্তিচুক্তির নামে স্বাক্ষরিত হয়েছে প্রতারণার নানা দলিল। সভ্যতার এসব আচরণকে প্রহসন বললেও কম বলা হয়। এমন প্রহসনের অতিসাম্প্রতিক উদাহরণ ইউএই-ইসরাইল শান্তিচুক্তি। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে চুক্তির পর ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসরাইল যেন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ১৬ আগস্ট উপর্যুপরি বিমান হামলার পর ১৭ আগস্ট ট্যাংক বহর নিয়ে হামলে পড়ে গাজা উপত্যকায় দখলদার ইসরাইলী বাহিনী। আল জাজিরা জানায়, বরাবরের মতো এবারো হামলার পক্ষে অজুহাত হিসেবে গাজা উপত্যকা থেকে রকেট ও আগুনবোমা নিক্ষেপের কথা জানিয়েছে ইসরাইলী বাহিনী।

ইউএই-ইসরাইল কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ঘটনায় আরব ও মুসলিম বিশ্বে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে আরব আমিরাতের দূতাবাসে হামলা হয়েছে। তাঁরা ওই চুক্তিকে ‘কলঙ্ক’ বলে অভিহিত করেছে। আমিরাতে নিযুক্ত ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রদূত এসাম মাসালহা আবুধাবি থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। ফিলিস্তিনীরা মনে করছেন, এই চুক্তি ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান নীতিকে ধ্বংস করবে এবং চরম পন্থাকে জোরদার করে সম্ভাব্য শান্তির পথকে বাধাগ্রস্ত করবে। এদিকে ইসরাইল-আমিরাত চুক্তি প্রসঙ্গে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের কার্যালয়ের মুখপাত্র নাবিল আবু রুদেইনাহ বলেন, এই চুক্তির বিরুদ্ধে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করবে ফিলিস্তিন। এই চুক্তি ফিলিস্তিন ও জেরুসালেমের নাগরিকদের অধিকারের লঙ্ঘন। এই চুক্তি ‘আরব পিস-ইনিশিয়েটিভ’কে ভেঙ্গে দিয়েছে। আরব লিগ অনুমোদিত ২০০২ সালের ওই চুক্তি অনুসারে ফিলিস্তিনের যেসব জায়গা ইসরাইল দখল করেছে, সেগুলো ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে দেশটির সঙ্গে আরব ও এই অঞ্চলের ইসলামী দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কথা ছিল। কিন্তু আমিরাতের সঙ্গে ইসরাইলের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে ওই দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে। আর আমিরাত বলছে এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল বন্ধ করবে ইসরাইল। কিন্তু ইসরাইল বলেছে, তারা ভূমি দখল সাময়িকভাবে স্থগিত রেখেছে, বাতিল করেনি। এ থেকে স্পষ্টভাবেই উপলব্ধি করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ইসরাইলের দুরভিসন্ধি ও কূটকৌশল। এ কারণেই হয়তো ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস বলেছেন, না সংযুক্ত আরব আমিরাত, না অন্য কোনো দেশÑ ফিলিস্তিনের নাগরিকদের নিয়ে কথা বলার অধিকার কারও নেই। কার সততায় বিশ্বাস রাখবে ফিলিস্তিনীরা?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার তিন বছর পর ১৯৪৮ সালে বৃটিশ শাসিত ফিলিস্তিনে ইহুদিরাষ্ট্র ইসরাইলের জন্ম হয়। পশ্চিমা বিশ্বের বানানো এ রাষ্ট্রকে মেনে নেয়নি আরবরা। ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও সবশেষে ১৯৭৩ সালে আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যুদ্ধ হয় ইসরাইলের। প্রতিবারই পরাজিত হয় আরবরা। আর এই পরাজয়ের কারণও স্পষ্ট। যুদ্ধ তো আসলে উড়ে এসে জুড়ে বসা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইসরাইলের সাথে ছিল না, যুদ্ধে প্রতিপক্ষ ছিল পশ্চিমা বিশ্ব। তাই অসম এই যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বৃটেন, আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের কিছু রাষ্ট্র আজও অন্যায়ভাবে, অনৈতিকভাবে ইসরাইলকে সমর্থন ও সহযোগতিা করে যাচ্ছে। আর এদের মধ্যে উগ্রভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন।
যুদ্ধ পরাজয়ের পর থেকে ইহুদিদের কাছে জমি হারাতে থাকে ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীরা। আর বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করছে ইসরাইলের প্রশাসন। ভূমি উদ্ধারের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনী জনগণ । আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন ও ইসরাইল দু’টি রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সংঘাত মেটানোর কথা বললেও তা এখনো সফলতার মুখ দেখেনি। বর্তমান সভ্যতার চালচিত্র লক্ষ্য করলে এর মাজেজা উপলব্ধি করা কঠিন নয়। সেই ইসরাইলের সাথে গত ১৩ আগস্ট এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ওই চুক্তি সম্পাদিত হয়। হামাস ও ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ ওই চুক্তির তীব্র নিন্দা জানায়। অনেকে এই চুক্তিকে ফিলিস্তিনীদের সাথে মহাবিশ্বাসঘাতকতা বলে অভিহিত করেছেন। এদিকে এ চুক্তির কারণে ইউএইকে হুঁশিয়ার করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান। ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার এ চুক্তির প্রতিবাদে আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছেন এরদোগান।
ইসরাইল-আমিরাত শান্তিচুক্তির ফলে উপসাগরীয় আরব দেশগুলোতে অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে অঞ্চলটিতে সংঘাত ও সহিংসতার আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সুযোগে অস্ত্র রফতানিকারক দেশগুলোর বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রি বাড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা। এদিকে গত ১৪ আগস্ট এক সাক্ষাৎকারে ইসরাইলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড ফ্রেইডম্যান বলেছেন, আমিরাত যত ইসরাইলের মিত্র, অংশীদার ও যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিত্র হবে; আমি মনে করি এতে হুমকির মাত্রা কমবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রিতে আমিরাত লাভবান হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, আরব দেশগুলোর তুলনায় তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র পাবে। যেমন লকহিড মার্টিনের তৈরি এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান যুদ্ধে ব্যবহার করছে ইসরাইল, কিন্তু আমিরাত এখনো তা কিনতে পারেনি।
এদিকে ইস্ট পলিসি থিংক ট্যাংকের ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের আরব-ইসরাইল সম্পর্ক প্রকল্পের পরিচালক ডেভিড মাকোভস্কি বলেন, এই চুক্তিটি আমিরাতের জন্য জয়। এর ফলে আমিরাত এমন সামরিক সরঞ্জাম কিনতে পারবে যা শুধু ইসরাইলই কিনতে পারে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে, এই আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র ওইসব সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করে না আরব দেশগুলোর কাছে। এইসব বক্তব্য থেকে আসলে কোন বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে? চুক্তি কি শান্তির পথে এগুচ্ছে, নাকি অস্ত্র বিক্রি তথা যুদ্ধের পথে? আর চুক্তির বদৌলতে আমিরাত যদি অত্যাধুনিক অস্ত্র পায়ও, তবে তা কি কখনো ইসরাইলের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে? তাহলে কেন অত্যাধুনিক অস্ত্র কেনা? এই অস্ত্র কি আরবরা নিজেদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে? নাকি এর মধ্যে রয়েছে বৃহৎ শক্তির রাজনৈতিক স্বার্থ ও অস্ত্র বিক্রির কূটকৌশল? বিষয়গুলো আরবদের উপলব্ধি করতে হবে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button