হিজরি সন মুসলমানদের ঐতিহ্য
মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী: মানবজীবন সময়ের সমষ্টি। সময়কে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহারোপযোগী করে আল্লাহতায়ালা প্রাকৃতিকভাবে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। যেমন রাত, দিন, মাস, বছর ইত্যাদি।
আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের মনজিল নির্দিষ্ট করেছেন, যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এটা নিরর্থক সৃষ্টি করেননি। জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য তিনি এসব নিদর্শন বিশদভাবে বিবৃত করেন।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ৫)
ইসলাম পূর্বকালে তারিখ গণনার জন্য আরবদের এমন কোনো উত্স ছিল না, যাকে কেন্দ্র করে তারা কয়েক দশক বা শতাব্দীকে চিহ্নিত করতে পারত। অবশ্য তারা তারিখ গণনার জন্য এক দশক বা কয়েক দশকের মধ্যে ঘটমান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহকে উত্স করে তা কেন্দ্রিক সাময়িক তারিখ গণনা করত। যেমন আবরাহার হাতি বাহিনীর মাধ্যমে মক্কা শহরে হামলা ও কাবাঘর সংস্কারের বছর, যা আমুল ফিল বা হাতির বছর নামে খ্যাত, কয়েক যুগ পর্যন্ত তারিখ গণনার উত্স হিসেবে ব্যবহূত হতো। পরে হজরত মোহাম্মদ (স)-এর নবুওয়াতের প্রচারের সময় যখন তিনি মদিনায় আরকামের বাসায় যান, তা তারিখ গণনার উত্স হিসেবে পরিণত হলো।
রাসুল (স) মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই। সেই দিনকে মহররম মাসের শুক্রবার হিসেবে ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু হয়। হিজরি সন হলো মুসলিমদের সন। কিন্তু সঠিক কখন থেকে হিজরত ইসলামি বর্ষপঞ্জির উত্স হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে তা সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকের মতে, উক্ত হিজরি হিসাবের প্রথম প্রয়োগ ঘটে ওমর (রা)-এর শাসনামলের ৩০ জুমাদাল উখরা/১৭ হিজরি অর্থাত্ ৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে।
হিজরত ইসলামি বর্ষপঞ্জির উত্স হওয়ার পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ প্রেক্ষাপট। হজরত ওমর (রা)-এর কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় চিঠি আসত। সেখানে মাসের নাম ও তারিখ লেখা হতো না, সন থাকত না। এতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে হজরত ওমর (রা)-এর খেলাফতকালে (১৭ হিজরিতে) ইরাক ও কুফার প্রশাসক হজরত আবু মুসা আশয়ারি (রা) হজরত ওমর (রা)-এর কাছে পত্র লিখলেন। যার বক্তব্য ছিল, ‘আমিরুল মুমিনিন! আপনার পক্ষ থেকে প্রায়শই বিভিন্ন উপদেশ, পরামর্শ ও নির্দেশ সংবলিত চিঠিপত্র আমাদের কাছে আসে। তবে সেগুলোতে সনের উল্লেখ না থাকায় যথাসময়ে সেগুলো পালন ও কার্যকর করতে আমাদের বেশ অসুবিধায় পড়তে হয়।’
এই গুরুত্বপূর্ণ পত্রটি পাওয়ার পর হজরত ওমর (রা) তত্ক্ষণাত্ নেতৃস্থানীয় সাহাবিদের একটি পরামর্শসভা ডাকলেন। মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র সাল প্রণয়নের জন্য শুরু হয় আলোচনা-পর্যালোচনা। কোন বছরটি হবে ইসলামি বর্ষপুঞ্জির প্রথম বর্ষ, সে ব্যাপারে পরামর্শ চাইলে চার ধরনের মতামত সামনে আসে। যথাক্রমে :নবীজির (স) জন্মের বছর, নবুওয়াতপ্রাপ্তির বছর। হিজরতের বছর এবং নবিজির (স) মৃত্যুর বছর।
এই চার রকমের মতামত আসার পর এগুলোর ওপর পর্যালোচনা করা হয়। হজরত ওমর (রা) বললেন যে, জন্ম বা নবুওয়াত থেকে ইসলামি বছরের শুরু ধরা হলে সমস্যা হলো, নবিজির জন্মের দিন ও নবুওয়াতপ্রাপ্তির দিনের ব্যাপারে মতবিরোধ আছে। আর মৃত্যুর সময় থেকে আরম্ভ করা এজন্য উচিত হবে না যে, মৃত্যুর বছর ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য শোক ও ব্যথার বছর। এজন্য উচিত হবে, হিজরতের সময় থেকে ইসলামি বছরের সূচনা করা। এতে চারটি ভালো দিকও আছে।
১. হজরত ওমর (রা) বলেন, হিজরতের মাধ্যমে হক-বাতিলের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য সূচিত হয়েছে। ২. হিজরতের পরই মুসলমানরা প্রকাশ্যে ইবাদত ও সমাজ গঠনের রূপরেখা বাস্তবায়ন করতে পেরেছিলেন। অর্থাত্ এ বছরেই ইসলাম শক্তিশালী হয়েছে। ৩. হিজরতের বছর থেকে নবি করিম (স) ও মুসলমান শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে নির্বিঘ্নে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন। ৪. এ বছরেই মসজিদে নববি নির্মিত হয়, যা মূলত ইসলাম প্রচার-প্রসারের কেন্দ্র বা মারকাজ হিসেবে বিবেচিত। সর্বোপরি হিজরত ইসলামের ইতিহাসে সতন্ত্র একটি মাইলফলক। তাই সাহাবায়ে কেরাম হিজরতের বছর থেকেই ইসলামি সালের গণনা শুরু করার সিদ্ধান্তে ঐকমত্যে পৌঁছান। ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় হিজরতের ১৬ বছর পর।
হিজরি বা চান্দ্রবর্ষের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। বিশেষত ইবাদতের তারিখ, ক্ষণ ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন রমজানের রোজা, ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা, হজ, জাকাত, শবে কদর, আশুরা এবং বিভিন্ন মাসের নফল রোজা ইত্যাদি ক্ষেত্রে চান্দ্রবর্ষ বা হিজরি সন ধরেই আমল করতে হয়। রোজা রাখতে হয় চাঁদ দেখে, ঈদ করতে হয় চাঁদ দেখে। এমনকি স্বামীর মৃত্যুর পর নারীদের ইদ্দতের ক্ষেত্রগুলোতেও চান্দ্রবর্ষের হিসাব গণনা করতে হয়।
অর্থাৎ মুসলমানদের ধর্মীয় কতগুলো দিন-তারিখের হিসাব-নিকাশের ক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলোতে চাঁদের হিসাবে দিন, তারিখ, মাস ও বছর হিসাব করা আবশ্যকীয়। মহান আল্লাহতায়ালার বাণী, ‘লোকেরা আপনাকে নবচন্দ্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, আপনি বলুন, তা হলো মানুষের এবং হজের জন্য সময় নির্ধারণকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৮৯)
আল্লাহর দৃষ্টিতে শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসই নির্ভরযোগ্য। চন্দ্র মাসের হিসাবমতেই রোজা, হজ, জাকাত প্রভৃতি আদায় করতে হয়। তবে কোরআন মাজিদ চন্দ্রকে যেমন, তেমনি সূর্যকেও সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করার মানদণ্ডরূপে অভিহিত করেছে। সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা জায়েয। তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। তাই শরিয়তের বিধিবিধানকে চন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেখেছেন। চান্দ্রবর্ষের হিসাব মেলালে দেখা যায়, একটি ইবাদতের মৌসুম কয়েক বছরের ব্যবধানে শীত-গরম-বর্ষায় পরিবর্তিত হতে থাকে। সৌরবর্ষে এটা হয় না। চান্দ্রবর্ষের হিসাব অনুযায়ী হওয়ায় একটি ইবাদত বিভিন্ন মৌসুমে পালনের সুযোগ মুসলমানরা পান।
হিজরি সন শুধু সন নয়, হিজরি সনের মাসগুলোর তারিখ ব্যবহারে ও চর্চায় রাখা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য কর্তব্য। মনে রাখতে হবে, চন্দ্র বছরের হিসাব সংরক্ষণ করা ফরজে কেফায়া। সকল উম্মত ভুলে গেলে সবাই গুনাহগার হিসাবে গণ্য হবে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। কাজেই এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার কর না।’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৬)।
নবীজি (স) আমাদের নতুন চাঁদ দেখার সময় দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন : আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল য়ুমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস সালামাতি ওয়াল ইসলামি রাব্বি ওয়া রাব্বুকাল্লাহু।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের জন্য এই চাঁদকে নিরাপত্তা, ঈমান, প্রশান্তি ও ইসলামসহযোগে আনয়ন করুন; আমাদের তাওফিক দেন আপনার মহব্বত ও সন্তুষ্টির; আমার ও আপনার প্রভু আল্লাহ! এই চান্দ্রমাস সুপথ ও কল্যাণের।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৪৭) হিজরি সন শুধুমাত্র আরবি বা কেবল আরবদের একটি সন নয়; বরং এটি মুসলমানদের সন এবং ইসলামি সন। এর গণনা ইসলামি সংস্কৃতির অনুসরণ। ইসলামি ঐতিহ্যের বাস্তব নমুনা। যা নিজ ঐতিহ্যকে অনুসরণ, অনুকরণ করতে শেখায়।
লেখক: মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ