বন্ডরে নাম সুকুক, সুকুকে সুদ নইে, আছে মুনাফা
ইসলামি বন্ড আসছে অক্টোবরে
প্রথমে ছাড়া হবে ১০ হাজার কোটি টাকা, বন্ডধারীরা পাবনে সম্পদরে মালকিানা
দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় ছিল ইসলামি বন্ড। কিন্তু অগ্রগতিতে ছিল কচ্ছপগতি। করোনার কারণে সরকারের রাজস্ব কমে যাওয়ায় এখন তা বিদ্যুৎগতি পেয়েছে। এই বন্ড দ্রুততার সঙ্গে বাজারে আনবে সরকার। প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়া হবে। যা আগামী অক্টোবরের মধ্যেই বাজারে আসবে। এরই মধ্যে নীতিমালা তৈরির কাজও শেষ হয়েছে বলে অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ইসলামি শরিয়ায় সুদ হারাম। অর্থ বিনিয়োগ করে যেহেতু সুদ নেওয়ার সুযোগ নেই, তাই সরকার খুব সহজেই এই বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। এ ধরনের বন্ড ‘সুকুক’ নামে পরিচিত। এই বন্ডের কোনো সুদ হবে না। তবে প্রকল্পের আয় থেকে যে লাভ হবে তার একটা অংশ দেওয়া হবে। এই বন্ড হবে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। ফলে সরকারের উপর সুদের বাড়তি চাপ থাকবে না।
সাধারণ বন্ডের মতোই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলামের মাধ্যমে এই বন্ডগুলো বিক্রি করা হবে। ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, যেসব ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ইসলামি ব্যাংকিং শাখা বা ইউনিট রয়েছে তারা এসব বন্ড কিনতে পারবে।
সরকার সাধারণত বাজেটের খরচ মেটাতে রাজস্ব সংগ্রহের পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র বিক্রি ও ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভর করে থাকে। তবে সরকার সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত তহবিল থেকেও ১৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এই অর্থ রাজস্ব খাতে ব্যয় করলেও সুকুকের অর্থ ব্যয় করতে হবে লাভজনক উন্নয়ন প্রকল্পে।
একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে সুকুকের জন্য ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে পর্যায়ক্রমে তা ৩০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হবে। যা ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত হবে। আগস্ট মাসে এক ভার্চুয়াল সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকগুলোর মতো ইসলামি ব্যাংকগুলোতেও এখন বিপুল পরিমাণ অর্থ পড়ে রয়েছে। দেশের পুরো ব্যাংক ব্যবস্থায় শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর অংশীদারত্ব প্রায় ২৫ শতাংশ। অথচ সরকারের ঘাটতি অর্থায়নে দেশে শরিয়াহভিত্তিক কোনো উপকরণ নেই। ফলে একদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অধিকতর নিরাপদ এ খাতে বিনিয়োগ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকছে, অন্যদিকে সরকার তার ঘাটতি অর্থায়নে প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল ব্যবহার করতে পারছে না। ঘাটতি অর্থায়ন সুকুকের মাধ্যমে করা হলে সরকারের সুদের ব্যয় কমবে বলে অর্থ বিভাগ বলছে।
ইসলামি বন্ড বা সুকুক চালুর পক্ষে যুক্তি দিয়ে অর্থ বিভাগ বলেছে, অবকাঠামো খাতে সরকারের বিনিয়োগ প্রকল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব অত্যন্ত বেশি, যা বেসরকারি খাতের মাধ্যমে আশা করা যায় না। এ কাজ করতে যে ঘাটতি অর্থায়ন করতে হয়, সরকার এখন পর্যন্ত তা করে আসছে প্রচলিত ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা থেকে। অথচ এ প্রক্রিয়ায় ইসলামি ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও শরিক হতে পারে। এর মাধ্যমে সহজেই সমাজের বৃহত্তর কল্যাণে নিজেদের সম্পৃক্ত করার সুযোগ নিতে পারে।
জানা গেছে, অবকাঠামো নির্মাণ এবং উন্নয়নমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘমেয়াদি অর্থসংস্থানের উৎস হিসেবে সুকুক ছাড়া হয়। প্রচলিত বন্ড ও ইসলামি সুকুক বন্ডের মধ্যে ধারণাগত ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিই হচ্ছে বন্ড। এতে ঋণের পরিমাণ, পরিশোধের সময় ও সুদের হার উল্লেখ থাকে। প্রচলিত বন্ডে সুদ, ফাটকা ইত্যাদি থাকায় তা শরিয়াহসম্মত নয়। আর সুকুক হচ্ছে এমন একটি বিনিয়োগ সনদ, যাতে সম্পদের ওপর মালিকানা দেওয়ার নিশ্চয়তা থাকে। সাধারণত সুকুকধারীরা সম্পদের মালিকানা লাভ করেন এবং মুনাফা পান।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা থমসন রয়টার্সের ২০১৬-১৭ সময়ে প্রকাশ করা বৈশ্বিক ইসলামি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে বৈশ্বিক ইসলামি অর্থায়নের সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ ট্রিলিয়ন বা দুই লাখ কোটি মার্কিন ডলার। বলা হয়, ইসলামি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এতই ইতিবাচক যে ২০২১ সালেই তা সাড়ে তিন ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকসূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড সুদভিত্তিক হওয়ায় ইসলামি ব্যাংকগুলো সরকারের ঋণের আওতামুক্ত ছিল। তবে ইসলামি বন্ড নীতিমালা সংশোধন করার পর থেকে ইসলামি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকেও সরকার ঋণ নিতে পারে।
নিয়ম অনুযায়ী, ইসলামি ব্যাংকগুলো একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মুনাফাভিত্তিক ইসলামি বন্ডে বিনিয়োগ করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সংবিধিবদ্ধ তারল্যের হার (এসএলআর) দেবে। সব ধরনের ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মালিক সরকার, তাই এ বন্ডের মাধ্যমে সরকার ঋণও নিতে পারে। একই সঙ্গে কোনো ব্যাংকে নগদ টাকার সমস্যা হলে সংকট মেটাতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত ইসলামি তহবিল থেকে ধার (রেপো) নিতে পারে।