বাংলাদেশের রাজনীতি এবং ড. লুডেনের উপলব্ধি
জামালউদ্দিন বারী :
একজন মার্কিন গবেষক ইতিহাসবিদ বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা নয়, বাংলাদেশ চালায় টুইসডে ক্লাব’। বাংলাদেশী লেখক ও মানবাধিকার অ্যাক্টিভিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা গ্রন্থ ‘ভাসানী কাহিনী’র প্রকাশনা উৎসব এবং বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট বিষয়ে এক বিশেষ সেমিনার অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয় নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দি ক্রাইসিস ইন বাংলাদেশ ফ্রম ভাসানী পারস্পেকটিভ’ শিরোনামের সেমিনারের প্রধান অতিথি নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক ড. ডেভিড লুডেন এই মন্তব্য করেছেন। তার মতে, বহুজাতিক পুঁজির প্রতিনিধি ইউরোপীয় ইউনিয়নের হাইকমিশনার এবং টুইসডে ক্লাবের সদস্য ও ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ চালায়। ড. লুডেন বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির দৈন্য এবং মওলানা ভাসানীর মতো রাজনৈতিক দার্শনিকের মূল্যায়নের উপর জোর দেন। আমাদের চলমান রাজনীতি ও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে নতুনভাবে পর্যালোচনায় নিয়ে আসতে একজন পশ্চিমা ইতিহাসবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকের এই মূল্যায়নের সাথে আমাদের দ্বিমত হওয়ার কোন অবকাশ নেই। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের কর্তা সেজে নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছেন সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসা পশ্চিমা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের অনুচররা। আর এই বাস্তব চিত্রের প্রতিফলন আমাদের সিভিল সোসাইটির সদস্যদের বক্তৃতায়, লেখায় তেমনভাবে প্রকাশিত না হলেও খোদ যুক্তরাষ্ট্রের একজন অধ্যাপকের জবানিতে খুবই স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হলো। শুধু এ বিষয়েই নয়, সাম্প্রতিক সময়ের কোন জাতীয় সঙ্কটেই আমাদের নাগরিক সমাজকে জাতীয় স্বার্থের অনুকূলে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। সুশীল সমাজ বা সিভিল সোসাইটির তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণীর নীরবতা বা দলবাজ বিভক্ত ভূমিকার কারণেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতি ও একগুঁয়েমি দেশকে এখন চরম সংঘাত ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। স্বাধীনতাত্তোর সময় থেকে দেশে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও সরকারগুলোর হীন দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে রাষ্ট্রের প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও উচ্চশিক্ষার মানের পাশাপাশি শিক্ষিত আমলা ও পেশাজীবী শ্রেণীর মধ্যে যে দুর্নীতি ও নৈতিক অবক্ষয় প্রভাব তার পড়েছে পুরো সমাজদেহে। বিশ্বের সব গণতান্ত্রিক সমাজেই দেশের প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অ্যাকাডেমিসিয়ান ও নাগরিক সমাজকে ঐক্যবদ্ধ ও দলনিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো সিভিল সোসাইটির আলাদা ও নিরপেক্ষ কোন কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে না। সরকার এবং বিরোধীদলের একগুঁয়েমি ও অগণতান্ত্রিক আচরণে একটি জাতীয় সংকট ঘণীভূত হয়ে ওঠার সময়েও আমাদের নাগরিক সমাজের কণ্ঠস্বর অতি ক্ষীণ ও দ্বিধাগ্রস্ত দেখা যাচ্ছে। দেশে এমন অনেক রাজনীতি হয়ে থাকে, যেসব রাজনীতির পশ্চাতে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কুশীলবরা সক্রিয় থাকেন। সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতিভূ বিদেশি কূটনীতিকরা বিভিন্ন সময়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রভাবিত করেছেন, কখনো কখনো তারাই রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনের নেপথ্য শক্তি হিসেবে কলকাঠি নেড়েছেন। এ প্রসঙ্গে ২০০৭ সালের এক-এগারো সেনাসমর্থিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপট তুলে ধরা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে এ দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ বার বার ব্যাহত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে সামরিক শক্তি রাষ্ট্রের চালকের আসনে আসীন হলেও দলনিরপেক্ষ সিভিল সোসাইটির কোন স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা দেখা যায়নি। এখন দেশ যখন আরেকটি সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সঙ্কটের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তখন ডেভিড লুডেনের মতো একজন বিদেশি অ্যাকাডেমিসিয়ান বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের প্রাণপুরুষ মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দর্শনের কথা তুলে ধরেছেন। সেই সাথে বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পশ্চিমা শক্তির ন্যক্কারজনক প্রভাবের কথাও বলেছেন প্রফেসর লুডেন।
দুই.
দেশে চলমান পুলিশি সন্ত্রাস, রাজনৈতিক দলগুলোর অবিমৃশ্যকারিতা ও অনিশ্চয়তার জন্য দেশের জনগণ যে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর উপর বিরক্ত তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। ব্যর্থ সরকারের প্রতি বিরক্ত হয়ে জনগণ বিকল্প হিসেবে ব্যর্থ বিরোধীদলকেই বেছে নিচ্ছেন। এক দলের ব্যর্থতার সুযোগে আরেক দলের ক্ষমতা গ্রহণের এই সংস্কৃতির পরিবর্তনে নাগরিক সমাজের কাছে সাধারণ মানুষ আরো বেশি সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশা করেন। ক্ষমতার পালাবদল দ্বিদলীয় চক্রে আবদ্ধ থাকার উদাহরণ বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশেও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের কথা বলা যায়। তবে সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা ও পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষ ভূমিকার কারণে সেখানকার সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো কখনো জনগণের উপর দুর্বৃত্তায়নের খড়গ চালাতে পারে না। একদিকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পদ পর্যন্ত ধাপে ধাপে নেতৃত্ব নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পন্থা ও মেধার লালন, অন্যদিকে দেশের শক্তিশালী মিডিয়া, অ্যাকাডেমিসিয়ান, থিঙ্কট্যাঙ্ক ও সিভিল সোসাইটির সচেতন ভূমিকা রাষ্ট্রশক্তির জন্য ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জাতীয় ইস্যুতেই বড় ধরনের রাজনৈতিক বিতর্ক ও মতপার্থক্য বিদ্যমান। দেশের ইতিহাসবিদ ও নিরপেক্ষ গবেষকরা এখনো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোর ন্যায়সঙ্গত ও গ্রহণযোগ্য মিমাংসায় পৌঁছতে কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। আমাদের জাতীয় রাজনীতির ইতিহাস এখনো কতগুলো ইমোশনাল মিথের উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব, সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা, স্বাধীনতাযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতার প্রেক্ষাপট, বিরোধিতাকারী সংগঠন ও সমর্থন ইত্যাদি অনেক কিছুই এখনো গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান হিসেবে স্থান লাভ করতে পারেনি। রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের সাথে জড়িয়ে আছে এ দেশের মুক্তিকামী জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, দীর্ঘ সংগ্রাম ও ত্যাগের ইতিহাস। আর আমাদের রাজনীতিকরা এ ইতিহাসকে সব সময় হীন দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে প্রচার করতে গিয়ে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে বিতর্কিত করে তুলেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর ঐকমত্য ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রয়োজনীয় গবেষণা ও পরিসংখ্যান গড়ে না ওঠায় এসব বিষয়ে নতুন নতুন গবেষণা-তথ্য হাজির করছেন বিদেশিরা। গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের শাসকরা স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন এবং দুই লাখ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন বলে উল্লেখ করে আসছেন। স্বদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসংখ্য মানুষের আত্মদানের বিষয় যে কোন দেশেই একটি অতি সংবেদনশীল বিষয়, প্রতিটি প্রাণই অমূল্য, স্বদেশের জন্য বিসর্জন দেয়া মানুষের উত্তরসূরিরা একই সঙ্গে বেদনা ও গর্ববোধ করে থাকেন। স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন অথচ তার কোন বিশ্বাসযোগ্য প্রামাণ্য তালিকা নেই, এটা হতে পারে না। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার হচ্ছে, অথচ এই সুদীর্ঘ সময়েও দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিসিয়ান, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট শর্মিলা বোসের লেখা ‘ডেড রেকনিং : মেমোরিজ অব দি ১৯৭১ বাংলাদেশ ওয়ার’ গ্রন্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে নানা রকম তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শর্মিলা বসু ভারতীয় রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের গৌরবময় উত্তরাধিকার বহন করছেন। একদিকে তার পিতামহ অবিভক্ত বাংলার রাজনীতিক শরৎচন্দ্র বসু, অন্যদিকে তার মায়ের চাচা লেখক ও বিশিষ্ট ভারতীয় ব্রিটিশ নাগরিক নীরদ চন্দ্র চৌধুরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ নিহত ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত হরনের মিথ ভেঙে নতুন তথ্য-উপাত্ত হাজির করায় শর্মিলা বসুর ‘ডেড রেকনিং’ একটি প্রবল রাজনৈতিক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কোন আবেগ-উচ্ছ্বাস দিয়ে নয়, সত্যিকারের তথ্য-উপাত্ত দিয়েই এই বিতর্কের অবসান হওয়া আবশ্যক, অন্যথায় শর্মিলা বসুর গবেষণালব্ধ তথ্যই বিশ্বের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে স্বীকৃতি পাবে। লন্ডনের গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘ডেড রেকনিং’র রিভিউতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রত্যক্ষ পক্ষসমূহÑ পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সকলের সাথে যোগাযোগ করে ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে শর্মিলা বসু তার গ্রন্থের তথ্য-উপাত্তগুলো সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সংখ্যায় উপনীত হয়েছেন। একইভাবে অনাবাসী বাংলাদেশী লেখক সাংবাদিক বিজে খসরুর লেখা ‘মিথ্স অ্যান্ড ফ্যাক্টস অব বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার : হাউ ইন্ডিয়া, ইউএস, চায়না, ইউএসএসআর শেপ্ড দ্য আউটকাম’ গ্রন্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অনেক অনালোচিত অজানা বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। ২০১০ সালে ভারতের রূপা পাবলিকেশন্স থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি প্রকাশের সাথে সাথেই হিন্দুস্তান টাইমসের বেস্ট সেলারের তালিকায় স্থান লাভ করলেও বাংলাদেশে বইটির কোন আলোচনাই চোখে পড়েনি।
তিন.
দেশে অন্তত ২ ডজন বিভিন্ন ধরনের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার শিক্ষক, গবেষক ও অ্যাকাডেমিসিয়ান রয়েছেন। প্রতিদিন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের টকশোতে চায়ের কাপে ঝড় তোলা আড্ডা ও বাকযুদ্ধের মহড়া দেখা যায় চলমান নানা ইস্যুতে। কিন্তু অমিমাংসিত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে তাদেরকে কোন নিরবচ্ছিন্ন ভূমিকা রাখতে দেখা যায় না। আমাদের রাজনীতিকরা যেমন যে কোন অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ইস্যুতেও প্রভাবশালী বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দিয়ে থাকেন, সে কারণে দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক সঙ্কটে পশ্চিমা কূটনীতিকরাই চালকের আসনে বসে থাকেন। আর এই কঠিন সত্যটি উপলব্ধি করে এর বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট অবস্থান গ্রহণের সাহস বা চেতনাও যেন আমাদের সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের নেই। মনে হয় আমাদের রাজনীতিক, সিভিল সোসাইটি ও অ্যাকাডেমিসিয়ানদের প্রতিনিধিত্ব করছেন লন্ডন, নিউইয়র্কের জর্জ গ্যালাওয়ে, ড. ডেডিড লুডেন ও শর্মিলা বোসরা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পুলিশের হাতে অসংখ্য মানুষ হত্যা, শাপলা চত্বরে বাতি নিভিয়ে মধ্যরাতে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ক্র্যাক-ডাউন সম্পর্কে লন্ডনে জর্জ গ্যালাওয়ে যে সোচ্চার প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছেন বাংলাদেশের কোন রাজনীতিক বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এই ভূমিকা রাখতে পারেননি। অন্যদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস, জাতীয় সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের উপর তীক্ষè ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ড. ডেভিড লুডেনকে অনেক বাংলাদেশী গবেষকের চেয়ে বেশি সোচ্চার মনে হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলায় গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক বৈষম্য, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ পরবর্তীতে রদের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ার পর ৫২’র ভাষা আন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনা ও ইতিহাসের বাঁক ও গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ড. লুডেনের চিন্তা ও গবেষণা অনেক বেশি স্বচ্ছ ও প্রখর। বাংলাদেশের চলমান বাস্তবতা ও রাজনৈতিক সঙ্কট সম্পর্কে তিনি যে মতামত রেখেছেন, সেখানে মওলানা ভাসানীর মতো রাজনীতিকের দর্শন এবং পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক স্বার্থের পাহারাদার কূটনীতিকদের সংঘ টুইসডে ক্লাবের ভূমিকা সম্পর্কে তার সাম্প্রতিক মতামতেই বাংলাদেশ সম্পর্কে তার চিন্তার গভীরতা ও বিস্তৃতি ধরা পড়ে। সাত সমুদ্রের ওপারে বসে ড. লুডেনসহ অনেক মুক্তবুদ্ধির ইতিহাস গবেষক যখন বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক মানস চেতনার পরিগঠনের উপাদানগুলো সম্পর্কে বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা তুলে ধরছেন তখন আজকে আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী যত্রতত্র দ্বি-জাতিতত্ত্বের অসাড়তা প্রমাণের চেষ্টা করছেন এবং ক্ষীণ স্বরে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছেন। ইতিহাসের সত্য কখনো রাজনৈতিক উত্তাপ বা আবেগের দ্বারা দীর্ঘদিন চাপা রাখা যায় না। আমাদের রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অর্থনৈতিক কর্মকা- ও সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলোকে জনগণের ইচ্ছার দ্বারা একটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদ-ে প্রতিষ্ঠিত করতে দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও সিভিল সোসাইটির সত্যনিষ্ঠ ভূমিকা প্রয়োজন। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে মিথ বা উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যাগুলো পরিহার করে অপ্রিয় সত্যকে আলিঙ্গন করতে হবে। আমাদের হীন দলকানা রাজনীতিকদের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের গ্যাড়াটোপ থেকে স্বাধীন দেশের উপযোগী নেতৃত্ব কায়েমের নাগরিক সমাজকে দলনিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়ে কাজ করতে হবে। দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের মূল সম্পদ। দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশি প্রেসক্রিপসনের রাজনীতি বন্ধ করে ১৫ কোটি মানুষের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগাতে পারলেই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।