নবীপ্রেমিকদের ইবাদতে মুখরিত মক্কা
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
একের পর এক হাজী সাহেবরা দলবেঁধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসে জমায়েত হচ্ছেন পবিত্র নগরী মক্কায়। হজের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, মক্কায় হাজীদের সমাগম ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশ-বিদেশের হজ যাত্রীদের মিলন মেলায় পরিণত হচ্ছে পবিত্র নগরী মক্কা। পবিত্র কাবা শরিফ, মসজিদে নববীসহ হজরত মুহাম্মদের (সা.) স্মৃতিধন্য মক্কা-মদিনার ঐতিহাসিক স্থানগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজী সাহেবদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠেছে। সবাই এসব জায়গায় ইবাদতে মশগুল হচ্ছেন। প্রত্যেক হাজী দিনে-রাতে সাধ্যমতো বিভিন্ন ইবাদতে নিজেদের ব্যস্ত রাখছেন। ওমরা, কোরআন তেলাওয়াত, সালাত আদায়, তাওয়াফ, সাঈসহ বিভিন্ন ইবাদতে মশগুল থাকছেন তারা। তবে দিনের বেলায় সেখানে অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে হাঁটা-চলায় অসুবিধা হচ্ছে হাজী সাহেবদের। সাধারণত দিনের বেলায় এখানে ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকে। তাই আমাদের দেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের লোকদের জন্য তা সহ্য করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
মক্কায় প্রচুর গরম আবহাওয়া বিরাজ করছে। বাংলাদেশ থেকে যেসব হাজী সাহেবরা এখনও মক্কায় যাননি, তারাও সে বিষয়টি খেয়াল রাখবেন। আসার সময় অবশ্যই প্রচুর স্যালাইন ও অতিরিক্ত তাপমাত্রাজনিত শারীরিক সমস্যার ওষুধ সঙ্গে নিয়ে যাবেন। হাজী সাহেবরা তাদের পোশাক-পরিচ্ছেদ কেনার ক্ষেত্রেও বিষয়টি খেয়াল রাখবেন। মক্কায় এসে আমাদের দেশের অনেকেই অতিরিক্ত গরমের কারণে বিভিন্ন অসুস্থতা বোধ করেন। তাই এখানে আসার পর দিনের বেলা প্রয়োজনের অতিরিক্ত ঘোরাফেরা থেকে বিরত থাকতে হবে। প্রচুর পানি পান করতে হবে, সম্ভব হলে স্যালাইন মেশানো পানি পান করতে হবে।
রাসূলে করিমের (সা.) স্মৃতি বিজড়িত পুণ্য ভূমি মদিনা। এর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা প্রত্যেক ঈমানদারের অন্তরের কাজ। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘যে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনাবলীকে সম্মান করবে তা হচ্ছে অন্তরের পরহেজগারিতার বহিঃপ্রকাশ’ (সূরা হজ : ৩২)। সে বিচারে মদিনা শরিফের ফজিলত অত্যধিক।
মদিনার প্রতি রাসূলে পাকের (সা.) ভালোবাসা ছিল অত্যধিক। তিনি মদিনা শরিফকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন, যাতে উম্মতের কাছেও মদিনা শরিফ প্রিয় হয়। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, যখন রাসূল (সা.) মদিনায় আগমন করলেন তখন হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত বেলাল (রা.) জ্বরাক্রান্ত হলেন। আমি রাসূলুল্লাহকে (সা.) এ সংবাদ দিলে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করলেনÑ ‘হে আল্লাহ! তুমি মদিনা শরিফকে আমাদের কাছে মক্কা শরিফ বা তার চেয়ে বেশি প্রিয় করে দাও, এর পরিবেশকে আমাদের অনুকূল করে দাও, এর পরিমাপে বরকত দান কর আর এখানকার জ্বরকে জুহফাহ্ নামক স্থানে পাঠিয়ে দাও। (বোখারি শরিফ)।
মদিনা শরিফ হলো বরকতময় স্থান। এ শহরের বরকতের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! মদিনা শরিফে মক্কা শরিফের দ্বিগুণ বরকত দান কর।’ (মুসলিম শরিফ)।
মদিনাবাসীর ফজিলত ইসলামে অনেক। মদিনা শরিফ ছাড়া পৃথিবীতে এমন কোনো স্থান নেই, যার অধিবাসীদের ইসলামী শরিয়তে ফজিলত রয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, মদিনা শরিফ আমার হিজরতস্থল, আমি ওফাতের পর শুয়ে এখানেই আরাম করব এবং এখান থেকেই আমি পুনরুত্থানের দিনে উঠব। আমার প্রতিবেশি মদিনাবাসীদের হিফাজত করা আমার উম্মতের ওপর উচিত, যতক্ষণ না তারা কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয়।
মদিনার মাটি ও ফল রোগের শিফা এমন একটি প্রবাদ রয়েছে। ‘শরফুল মাকানে বিল মাকিন’ তথা অবস্থানকারীর কারণে স্থান মর্যাদাপূর্ণ হয়। মদিনা শরিফে যিনি শুয়ে আছেন, তাঁর সঙ্গে সৃষ্টি জগতের কোনো কিছুর তুলনা হয় না এবং যাঁর গুণ বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আমাদের প্রিয় রাসূল হজরত মুহাম্মদ (সা.), তাই মদিনা শরিফের মাটি, ধুলোবালি এমনকি ফলফলাদি অন্য কোনো মাটি, ধুলোবালি ও ফলফলাদির সঙ্গে তুলনা হয় না। মদিনা শরিফের মাটি, ধুলোবালি হলো জ্বর, কুষ্ঠ রোগ ও শ্বেত রোগের জন্য শিফা। কেউ কেউ বলেছেন, এটি প্রত্যেক রোগের শিফা। মদিনা শরিফের মহানবীর (সা.) স্মৃতি বিজড়িত ‘আজওয়া’ নামক খেজুরের মধ্যেও রয়েছে রোগের শিফা। রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘মদিনার আজওয়া নামক খেজুরের মধ্যে শিফা রয়েছে’। (মুসলিম শরিফ)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি প্রতিদিন সকালে সাতটি মদিনার আজওয়া নামক খেজুর খাবে, তাকে সেদিন না কোনো বিষ ক্ষতিসাধন করতে পারবে, না কোনো যাদু তাকে স্পর্শ করতে পারবে।’ (বোখারি ও মুসলিম)।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে দুটি শক্তি কাজ করে- প্রবৃত্তি ও বিবেক। প্রবৃত্তি মানুষকে মন্দের দিকে আকর্ষিত করে আর বিবেক তাকে মন্দ থেকে বাঁচিয়ে ভালো কাজে উৎসাহিত করে। কিন্তু মানুষের পেছনে আছে শয়তান। এ শয়তান মানুষের প্রবৃত্তিকে আরও শক্তি জোগায়। শয়তান মানুষকে কুমন্ত্রণা ও কুপ্ররোচনা দেয়, যাতে করে প্রবৃত্তি শক্তিশালী হয়। কাজেই অনেক মানুষের মধ্যে বিবেকের তুলনায় প্রবৃত্তি শক্তিশালী এবং প্রবল হয়। সে কারণেই মানুষ অন্যায়, অত্যাচার চালায় এবং অশ্লীল ও মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। তার নৈতিকতার অবক্ষয় হয়, আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে, মূল্যবোধ ভূলুণ্ঠিত হয়। তখন মানুষ আকর্ষণীয় মন্দ কাজ করে মজা পায়, তৃপ্তি পায়। মানুষ অনৈতিক জীবনযাপন করে। এভাবে তার ব্যক্তি, পরিবার ও সামাজিক জীবনে আসে বিপর্যয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো শয়তানের কুপ্ররোচনা ও কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা করা। হজে কঙ্কর ছুড়ে শয়তানকে ঘৃণা করার এবং শয়তানকে বর্জন করার এক প্রতীকী মহড়া দেওয়া হয়। যেমন, ইসমাইল (আ.) শয়তানকে ঘৃণা করে তার কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষার জন্য পাথর মেরেছিলেন, কঙ্কর মেরেছিলেন। হজেও প্রত্যেক হাজীকে সে শয়তানের ওপর প্রতীকী কঙ্কর মেরে শয়তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে হয়। শয়তানকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে আঘাত করতে হয়। শয়তানকে বর্জন করার জন্য এবং শয়তানের কুপ্ররোচনা ও কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষার দৃঢ় প্রত্যয়, অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। কোনো হাজী যদি ইসমাইলের (আ.) সেই মানসিকতা নিয়ে এবং ইসমাইলের (আ.) কঙ্কর মারার স্থানগুলোতে শয়তানের ওপর কঙ্কর মারে, তাহলে তার জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে। সে যদি সত্যি জিন শয়তান ও মানুষ শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা করে বেঁচে থাকতে পারে আর সেখানে তা অঙ্গীকার করে ফিরে এসে তাতে অটল ও সুদৃঢ় থাকতে পারে, তাহলে তার প্রবৃত্তি হবে পদানত, শয়তান হবে পরাজিত। আর যদি তা হয়, তখন সে হবে নৈতিকতায় উজ্জীবিত এবং মূল্যবোধ সমন্বিত।
৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় সুদীর্ঘ ১০টি বছর বসবাস করেন। এখানে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত বহুসংখ্যক স্থান, গৃহ, কূপ, উপত্যকা, পর্বত, কবরস্থান, রণাঙ্গন ও মসজিদ রয়েছে। আমরা এখানে সেগুলোর কিছুসংখ্যক উপস্থাপন করছি।
রাসূলুল্লাহ (সা.) মোটামুটি ৬৪টি স্থানে নামাজ পড়েছেন। এগুলোর ১৮টি বর্তমানে সুস্পষ্ট শনাক্তকৃত ও অবশিষ্ট ৪৬টি মসজিদের সাবেক অবস্থান সম্পর্কে দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।
মসজিদে কুবা : রাসূলুল্লাহর (সা.) মাদানি জীবনের সর্বপ্রথম মসজিদ। কোরআনে আছে, প্রথমদিন থেকেই এ মসজিদের ভিত্তি তাকওয়ার ওপর সুপ্রতিষ্ঠিত। মসজিদে নববী থেকে এর দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। এটি মদিনা শহরের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। মক্কা-জিদ্দা নতুন এক্সপ্রেস রোড কুবাতে এসে মিশেছে। মসজিদে নববীর কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ রিয়াল ভাড়ায় ট্যাক্সিতে এখানে যাওয়া যায়। কেউ চাইলে হেঁটেও যেতে পারেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) এখানে হেঁটে ও যানবাহনে যাতায়াত করেছেন। হাদিসে আছে, তিনি (সা.) প্রতি শনিবারে মসজিদে কুবায় যেতেন হেঁটে অথবা যানবাহনে আরোহণ করে। এরপর তিনি এখানে দু’রাকাত নামাজ পড়তেন। (বোখারি, হা. নং ১১৯৩; মুসলিম, হা. নং ৫১৬)। তাঁর অনুসরণে এখানে আগমন করা ও দু’রাকাত নামাজ আদায় করা সুন্নত। সাহাবা-ই-কেরাম (রা.) এ সুন্নত অনুযায়ী সাধারণভাবে আমল করেছেন। এ মসজিদে দু’রাকাত নামাজ পড়া একটি ওমরা পালনের সমান। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজগৃহে পবিত্রতা অর্জন করে, এরপর তিনি মসজিদে কুবায় আসেন এবং নামাজ আদায় করেন তাহলে তিনি একটি ওমরা পালনের সমান সওয়াব লাভ করেন। (সুনান ইবনে মাজাহ, হা. নং ১৪১২)।
মসজিদে নববী : রাসূলুল্লাহর (সা.) হাতে গড়া তাঁর মাদানি জীবনের দ্বিতীয় মসজিদ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তিনটি মসজিদের উদ্দেশ্যেই কেবল সফরের আয়োজন করা যায় : মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী ও মসজিদুল আকসা। (বোখারি হা. নং ১১৮৩, মুসলিম হা. নং ৫১১)। এ মসজিদে নামাজ আদায়, অন্য মসজিদের এক হাজার নামাজ অপেক্ষা শ্রেয়। (বোখারি হা. নং ১১৯০, মুসলিম ৫০৫, ৫০৮, ৫০৯)। অনেক হাজী ও পরিভ্রমণকারীর ধারণা যে, এখানে একনাগাড়ে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ অদায় না করলে নয়।
রওজা মুবারাকা : রাসূলুল্লাহর (সা.) গৃহ (হুজরা) ও মিম্বরের মধ্যবর্তী মসজিদ চত্বরকে রওজা বলা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার গৃহ ও আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থান জান্নাতের রওজাগুলোর (উদ্যান) একটি রওজা। (বোখারি ১১১৫, ৬৫৮৮, মুসলিম ৫০০, ৫০২)। এতে বোঝা যায় যে, এ রওজায় নামাজ আদায়, কোরআন তেলাওয়াত, জিকর-আজকার প্রভৃতি এ মসজিদের অন্যান্য স্থানের চেয়ে সন্দেহাতীতভাবে অধিক সওয়াবের কাজ। অনেকে রাসূলুল্লাহর (সা.) কবরকে রওজা অভিহিত করেন।
মসজিদে জুমা : রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনা প্রবেশকালে পথে শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করেন কুবা পল্লীর অদূরে রানুনা উপত্যকার বনু সালেম গোত্রের বসতিতে। তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন শতাধিক সাহাবি। ইসলামের সর্বপ্রথম জুমার নামাজ এখানেই আদায় করা হয়। পরবর্তীকালে এখানে মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এটিই মসজিদে জুমা।
মসজিদে কেবলাতাইন : দুই কেবলার মসজিদ হলো মসজিদে কেবলাতাইন। এটি মসজিদে নববী থেকে উত্তর-পশ্চিমে ৪ কিলোমিটার দূরে খালিদ বিন ওয়ালিদ রোডের পাশে অবস্থিত। এর পশ্চিমেই রয়েছে আকিক উপত্যকা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বনি সালামার উম্মে বাশারের (রা.) গৃহে জোহরের নামাজ পড়ছিলেন। তার দু-রাকাত ফরজ আদায়ের পরে তিনি কাবার দিকে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ পান এবং অবশিষ্ট দু’রাকাত (মসজিদে আকসার পরিবর্তে) কাবার দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করেন। সেদিন ছিল ২য় হিজরির রজব মাসের মাঝামাঝি সময় সোমবার।
মসজিদে গামামা : রাসূলুল্লাহ (সা.) মসজিদে নববীব পাশে উন্মুক্ত স্থানে অর্থাৎ মানাখা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সর্বপ্রথম ঈদের নামাজ পড়েন হিজরি ২য় সালে। গামামা অর্থ মেঘ। বৃষ্টি প্রার্থনার নামাজও এখানে পড়া হয়েছে। তিনি (সা.) মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এ ময়দানকে ঈদগাহ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বর্তমানে মসজিদ নববীর ব্যাপক সম্প্রসারণের পরিপ্রেক্ষিতে এটি মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে।
সাকিফা বনি সায়েদা : সাকিফা হচ্ছে উত্তরদিকে দেয়ালবিহীন ও অবশিষ্ট তিন দিকে ইট-পাথরের দেয়াল ঘেরা বেশ খোলামেলা মিলনায়তন। বনি সায়েদার এ সাকিফাটি মসজিদে নববী থেকে ৫০০ মিটার দূরে কিন্তু বর্তমানে তা সম্প্রসারিত মসজিদে নববীর উত্তর-পশ্চিম কোণে সন্নিহিতভাবে অবস্থিত।
ছানিয়াতুল বিদা : ছানিয়াতুল বিদা অর্থ বিদায়কেন্দ্র বা বিদায়ের পাহাড়ি পথ। মদিনাতে দুটি স্থানের নাম ছানিয়াতুল বিদা। একটি মক্কা-অভিযাত্রীদের বিদায়কেন্দ্র, যা আকিক উপত্যকার নিকটবর্তী এবং অপরটি সিরিয়া-অভিযাত্রীদের বিদায়কেন্দ্র, যা মসজিদ রায়াহ ও সালা পাহাড়ের কাছে অবস্থিত। সর্বপ্রথম মদিনা প্রবেশকালে বা তাবুক থেকে মদিনা প্রত্যাবর্তনকালে এ দুটি বিদায়কেন্দ্রের একটিতে বা উভয়টিতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) ব্যাপক অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করা হয় । মদিনার লোকজন তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গেয়েছিলেন, ‘ছানিয়াতুল বিদা থেকে আমাদের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উদিত হয়েছে।’
আবু আইয়ুব আনসারির (রা.) গৃহ : রাসূলুল্লাহর (সা.) হুজরাগুলোর ঠিক বিপরীত পাশে এবং মসজিদে নববীর দক্ষিণ-পূর্বে আবু আইয়ুব আনসারির (রা.) ঘরটি ছিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে সর্বপ্রথম এ ঘরেই বসবাস করেছেন। ঘরটি ছিল দোতলা। রাসূলুল্লাহ (সা.) থাকতেন নিচতলায় এবং আনসারি (রা.) থাকতেন দোতলায়। পরবর্তীকালে আনসারির (রা.) পীড়াপীড়িতে রাসূলুল্লাহকে (সা.) দোতলায় বসবাস করতে হয়।
ঐতিহাসিক কূপ : মদিনায় রাসূলুল্লাহর (সা.) স্মৃতি বিজড়িত ১৯টি কূপের কথা জানা যায়। মসজিদে নববী থেকে আধা কিলোমিটার দূরে বোদায়া নামক স্থানে ছিল বোদায়া কূপ। এর পূর্ব পাশে ছিল হা কূপ। এ দুটি কূপের পানি রাসূলুল্লাহ (সা.) পান ও ব্যবহার করেছেন। কুবা ও কুরবান যাওয়ার পথে বোসসা বাগানের বড় কূপটি বোসসা কূপ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ কূপের পানি দিয়ে মাথা ধৌত করেছেন ও ব্যবহৃত পানি কূপে ঢেলে দিয়েছেন। কুবা মসজিদের ৪২ মিটার দূরে আরিস কূপ অবস্থিত ছিল। এ কূপের মুখে রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বসতেন এবং এ কূপেই ওসমানের (রা.) আংটিটি হারিয়ে যায়। বর্তমানে কূপটি অস্তিত্বহীন ও সম্প্রসারিত কুবা মসজিদের অন্তর্ভুক্ত। কুবা মসজিদের আধা মাইল দূরে গারস কূপ অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ কূপের পানি দিয়ে তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী লাশ গোসলের অসিয়ত করেন এবং তাঁকে কুলপাতা মিলিয়ে তিনবার এ কূপের পানি দিয়েই গোসল করানো হয়। মসজিদে নববী থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সড়কের পাশে রূমাহ বা উসমান কূপ অবস্থিত, যা আকিক উপত্যকার মাঝখানে বিদ্যমান। জারওয়ান কূপে রাসূলুল্লাহকে (সা.) লাবিদ ইহুদি যাদু করেছিল। তা বাবুল আওয়ালি সংলগ্ন নাখাওয়ালার সামনের মহল্লায় অবস্থিত ছিল। যাদুর ব্যাপারটি প্রকাশ পাওয়ার পরে কূপটি অকেজো করে দেয়া হয়।
রাসূলুল্লাহর (সা.) কবর : আয়েশার (রা.) হুজরায় রাসূলুল্লাহ (সা.) ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁরই পাশে শায়িত আছেন তাঁরই একান্ত সঙ্গী আবু বকর (রা.) ও ওমর (রা.)। রাসূলুল্লাহর (সা.) কবর জিয়ারত ও তাঁকে সালাম প্রদান মোমিন জীবনের এক কাক্সিক্ষত বিষয়।
বাকী কবরস্থান : বাকী কবরস্থান মদিনা শহরের পূর্বাংশে ও সম্প্রসারিত মসজিদে নববীর পূর্বদিকে অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) রাতে এ কবরগুলো জিয়ারত করতেন। এ কবরস্থানের দক্ষিণে রয়েছে লাশ গোসলভবন ও পুলিশকেন্দ্র। এখানে রাসূলুল্লাহর (সা.) সাহাবা, স্ত্রীগণ, কন্যাগণসহ আহলে বায়তের অনেকের কবর রয়েছে। তাঁদের কবর জিয়ারত করা সুন্নত।
পাহাড়-উপত্যকা : ওহুদ পাহাড় মদিনার উত্তর দিকে সাড়ে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ওহুদ যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সা.) এ পাহাড়ে জোহর ও আসর নামাজ পড়েছেন। এখানে হামজাসহ (রা.) শুহাদায়ে ওহুদের কবর রয়েছে। খন্দকের যুদ্ধে প্রিয়নবী (সা.) সালা পাহাড়ের পাদদেশে সেনাছাউনি স্থাপন করেন ও সেখানে রাতযাপন করেন। এ যুদ্ধে তিনি (সা.) জোবাব পাহাড়ের ওপরও তাঁবু খাটিয়ে তাতে অবস্থান করেন। ওহুদ পাহাড়ের পেছনে উত্তর দিকে ছাওর পাহাড়। এটি মদিনা হারামের উত্তর সীমানা। মসজিদে নববী থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে আইর পাহাড়। এটি মদিনা হারামের দক্ষিণ সীমানা। আকিক উপত্যকা মূল মদিনার পশ্চিমে অবস্থিত। বাবুল আম্বারিয়া থেকে মাদরাজ হয়ে আকিকে যাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) আকিকে বেশ যাতায়াত করতেন ও এখানের পানি ও চমৎকার পরিবেশ দ্বারা মুগ্ধ হতেন।
আইয়ামে তাশরিক : জিলহজ মাসের ১১, ১২, ১৩ তারিখকে আইয়ামে তাশরিক বলা হয়।
ইজতিবা : ডান বগলের নিচ দিয়ে চাদরের প্রান্ত বাম কাঁধের ওপর উঠিয়ে রাখা। এভাবে ডান কাঁধ খালি রেখে চাদরের উভয় প্রান্ত বাম কাঁধের ওপর ঝুলিয়ে রাখা।
ইয়াওমুত তারবিয়াহ : জিলহজ মাসের ৮ তারিখ মিনায় যাওয়ার দিন।
উকুফ : অবস্থান করা। আরাফা ও মুজদালিফায় অবস্থান করাকে যথাক্রমে উকুফে আরাফা ও উকুফে মুজদালিফা বলা হয়।
জামরাহ : শাব্দিক অর্থ পাথর। মিনায় অবস্থিত শয়তানকে পাথর মারার স্থান। জামরার সংখ্যা তিনটি।
তাওয়াফে ইফাজা বা তাওয়াফে জিয়ারাহ : ১০ জিলহজ কোরবানি ও হলক-কসরের পর থেকে ১২ জিলহজের মধ্যে কাবা শরিফের তাওয়াফ করাকে তাওয়াফে ইফাজা বা তাওয়াফে জিয়ারাহ বলে। এ তাওয়াফ ফরজ।
তাওয়াফে কুদুম : আগমনী তাওয়াফ। মিকাতের বাইরের লোকেরা যখন হজ বা ওমরার উদ্দেশ্যে কাবা শরিফে আসেন, তখন তাদের বায়তুল্লাহ তথা কাবার সম্মানার্থে এ তাওয়াফটি করতে হয়। এটি ওয়াজিব।
বাতনে ওয়াদি : বাতনে ওয়াদি শব্দ দুটির অর্থ উপত্যকার মধ্যভাগ। সাফা ও মারওয়া পাহাড় দ্বয়ের মাঝখানে নিচু উপত্যকা ছিল। সে উপত্যকাটিকেই বাতনে ওয়াদি বলে।
লেখকঃ শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও কলামিষ্ট।