ওপেকের ৬ দশক

অনিন্দ্য সাইমুম ইমন: সময়ের আবর্তনে সুদীর্ঘ ছয়টি দশক পার করল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের রফতানিকারকদের জোট অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ (ওপেক)। ১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যাত্রা করে আজ এ জোটের বয়স পাক্কা ৬০ বছর। ছয় দশকের যাত্রাপথে সাফল্য-ব্যর্থতায় অনেক গল্প জমা হয়েছে ওপেকের ঝুলিতে। জ্বালানি তেলের বাজার হিস্যায় জোটভুক্ত দেশগুলোর গুরুত্ব উত্তরোত্তর বেড়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে ওপেক জোটের প্রভাব। এর বিপরীতে সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় সৌদি আরবের একক আধিপত্য, যুক্তরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন প্রভাব, ছোট দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থতা, এমন নানা ইস্যুতে বিভিন্ন সময় সমালোচনার মুখে পড়েছে জোটটি। এখন করোনাকালে জ্বালানি তেলের বাজারে ধস ঠেকানো এবং এটা করতে গিয়ে জোটের ঐক্য ধরে রাখা ওপেকের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করা হচ্ছে। তাই ছয় দশক পূর্তিতে সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান তুলে রেখে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যকর উপায় এগিয়ে নেয়াকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে ওপেক।

ওপেকের বীজ বপন হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরই। জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ রাষ্ট্র ইরান ও ভেনিজুয়েলা এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশগুলোকে নিয়ে জোট গড়ার কারিগর। তবে ১৯৬০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করে ওপেক। ওই সময় জোটের সদস্য ছিল মাত্র পাঁচটি দেশ—ইরান, ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব ও ভেনিজুয়েলা। ১৯৬৫ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ওপেকের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়, যা এখনো কাজ করে যাচ্ছে। সময়ের আবর্তনে এখন জোটের সদস্য দেশ ১৩টি। প্রতিষ্ঠাতা পাঁচ সদস্যের পাশাপাশি আফ্রিকা থেকে যুক্ত হয়েছে আলজেরিয়া, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো, ইকুয়েটোরিয়াল গিনি, গ্যাবন, লিবিয়া, নাইজেরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলনের ৪৪ শতাংশ ওপেকভুক্ত দেশগুলো জোগান দেয়। জ্বালানি পণ্যটির মোট বৈশ্বিক মজুদের (ভূগর্ভস্থ) ৮১ দশমিক ৫ শতাংশ রয়েছে ওপেকের সদস্য দেশগুলোয়। এ থেকে জ্বালানি তেলের বাজারে ওপেকের প্রভাব সম্পর্কে অনুমান করা যায়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে জ্বালানি তেলের বাজারে ওয়াচডগ হিসেবে কাজ করেছে ওপেক। বিশেষত সংকটকালে জ্বালানি পণ্যটির বাজার নিয়ন্ত্রণ ও মূল্য নির্ধারণে এ জোটের উদ্যোগ প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিশেষত গত শতকে ইরানে ইসলামী বিপ্লব, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, উপসাগরীয় যুদ্ধ, চলতি শতকের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে সন্ত্রাসী হামলা, এর জের ধরে ইরাক, আফগানিস্তানে মার্কিন হস্তক্ষেপ ও যুদ্ধ, সিরিয়া ও লিবিয়ায় বিদ্যমান সংঘাত, এমন নানা সংকটে জ্বালানি তেলের বাজার রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে ওপেক, যা জ্বালানি তেলের বাজার পরিস্থিতিকে বড় ধরনের ধস থেকে রক্ষা করেছে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর পেট্রোডলারের প্রবাহ সুনিশ্চিত করতে ওপেকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তেল বিক্রির এ অর্থ ইউএই, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শান-শওকতের ভিত্তি।
তবে ইরান ও ভেনিজুয়েলার স্বপ্নপ্রসূত হলেও শুরু থেকেই ওপেকের অঘোষিত নেতৃত্বে রয়েছে সৌদি আরব। ইসলামী বিপ্লব-পরবর্তী সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সৌদি আরবের প্রধান শত্রু ইরান। আর বিশ্ব রাজনীতিতে সৌদি আরবের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে আদর্শগত বিরোধের কারণে ভেনিজুয়েলার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ঐতিহাসিক। ২০২০ সালে এসেও ইরান ও ভেনিজুয়েলার বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে। তাই সমালোচকদের দাবি, সৌদি আরবের একক আধিপত্যের কারণে অনেক সময়ই ওপেকের সিদ্ধান্তে ও উদ্যোগে ওয়াশিংটনের ছায়া রয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানি তেলের বাজারে রুশ-সৌদি মূল্যযুদ্ধ নিরসনেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছায়া অনেক সময় ওপেকের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জেফ কোলগানের মতে, ওপেক অনেক সময় রাজনৈতিক দলের মতো আচরণ করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে যায়। দেখে মনে হয়, বাইরে থেকে আগেই নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত জোটের দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সমস্যা না থাকলে জ্বালানি তেলের বাজারে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত ওপেক।
সুদীর্ঘ ৬০ বছরের যাত্রাপথে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের অন্যতম শীর্ষ উত্তোলনকারী ও রফতানিকার দেশগুলোকে জোটভুক্ত করতে না পারা ওপেকের বড় ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, কাতার, ব্রাজিলের মতো দেশগুলো আজও এ জোটের সদস্য হয়নি। গত বছর ব্রাজিলকে সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল ওপেক। এ প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি দেশটি। ওপেক সদস্যের মধ্যে সাতটি দেশই আফ্রিকার। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় গিনি, অ্যাঙ্গোলা, গ্যাবনের মতো ছোট দেশগুলোর স্বার্থ উপেক্ষিত রয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি ইরান ও ভেনিজুয়েলার জ্বালানি তেল খাতের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নিতে সফল হয়নি জোটটি।
এ তো গেল আগের খতিয়ান। করোনা মহামারী শুরুর পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে ওপেক। দেশে দেশে লকডাউনের জের ধরে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক চাহিদায় রেকর্ড পতন দেখা দিয়েছে। মার্চে ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে ব্যারেলপ্রতি শূন্য ডলারের নিচে ঠেকেছিল জ্বালানি পণ্যটির দাম। এর মধ্য দিয়ে জ্বালানি তেলের বাজার ভারসাম্য ফেরাতে কয়েক বছর ধরে চলমান ওপেকের উদ্যোগের সফলতা হুমকিতে পরে। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ফের চিত্রপটে আসে ওপেক। জোটভুক্ত না হলেও রাশিয়াকে সঙ্গে নিয়ে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন কমাতে চুক্তি করে জোটটি। এ চুক্তির আওতায় ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থানে নামিয়ে আনা হয় জ্বালানি পণ্যটির উত্তোলন।
তবে চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে। করোনা মহামারী বিশ্ব অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি করেছে। শুরু হয়েছে মন্দা। সামনে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি আরো অনিশ্চিত পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে অনেক দেশ জ্বালানি তেলনির্ভরতা কমিয়ে পরিবেশবান্ধব অর্থনীতির পথে ঝুঁকছে। জ্বালানি তেলের বাজারে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রভাব ও বিরোধ দুটোই বাড়তির দিকে রয়েছে। এসব কারণে আগামী দিনগুলোয় অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বাজার ভারসাম্য রক্ষা ও কাঙ্ক্ষিত মূল্যবৃদ্ধিতে ওপেককে আরো কৌশলী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পেট্রোডলার প্রবাহের দিন বিদায় নিয়েছে। এখন প্রতিযোগিতা নানামুখী মেরুতে বিভক্ত। ৬০ বছর পেরিয়ে আগামী দিনগুলোয় সব দিক সামলে নিজেদের মধ্যকার ঐক্য ধরে রাখা, সদস্য সংখ্যা বাড়ানো, সদস্যদের স্বার্থ রক্ষা এবং সর্বোপরি জ্বালানি তেলের বাজারে যেকোনো ধরনের ধস ঠেকিয়ে রাখাই হবে ওপেকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও বড় চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার পথে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক উত্তোলন হ্রাস চুক্তি ও মিত্র দেশগুলোর মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও ঐক্য ওপেকের বড় অস্ত্র।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button