আন্দোলন সংগ্রামের নিবেদিত প্রাণ সৈয়দ আতাউর রহমান আর নেই
সিলেটের ইসলামী আন্দোলন সংগ্রামের নিবেদিত প্রাণ আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান আর নেই। তিনি আজ ২৪ অক্টোবর ২০২০, সকাল ৭টায় আখালিস্থ মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার ছেলে বিশিষ্ট কবি, গবেষক সৈয়দ মবনু জানান, বাদ আসর জগন্নাথপুরের সৈয়দপুর দরগাহ মসজিদ প্রাঙ্গনে জানাযা অনুঠিত হবে।
বর্ণাঢ্য জীবন: আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান। জন্ম ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারি বর্তমান সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী সৈয়দপুর গ্রামে। তিনি হযরত শাহ জালাল (র.)-এর ৩৬০ সাথীর অন্যতম হযরত সৈয়দ শাহ শামসুদ্দিন (র.)-এর বংশধর। তাঁর পিতার মরহুম হাজী সৈয়দ শমসাদ আলী একজন দ্বিনদার ব্যবসায়ি ছিলেন এবং মা মরহুমা লালকাচাই খানম তৎকালিন সময়ের মহিলাদের মধ্যে দ্বীনি মাসআলার তালিম দানকারী মুবাল্লিগ ছিলেন। তিনি তখন গ্রামে উর্দু কিতাব পড়ে মহিলাদেরকে তালিম দিতেন। তারা তিন মায়ের গর্ভের ছয় ভাইয়ের মধ্যে আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান চার নম্বার এবং তাঁর মায়ের গর্ভের তিনি তিন নম্বার। অল্প বয়সে তারা তাদের মা হারান। তাঁর ভাইরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
সৈয়দ আতাউর রহমান যৌবনের শুরুতেই বৃটেন প্রবাসী হয়ে যান। প্রবাসে প্রথমদিকে তিনি তাঁর বড়ভাই সৈয়দ আব্দুর রহমানের সাথে কিডিমিনিস্টার শহরে অবস্থান করেন। পরে তারা ব্যবসায়িক কারণে চলে আসেন বার্মিংহাম শহরে। তারা দুই মিলে বৃটেনে প্রথম হালাল মিট-চিকিনের ব্যবসা শুরু করেন। ’ বিবিসি ফর-এর একটি অনুসন্ধানী গ্রæপের মতে বৃটেনে প্রথম হালাল খাদ্যের আবিস্কারক তাঁর বড়ভাই সৈয়দ আব্দুর রহমান। সৈয়দ আব্দুর রহমান বলেন, তাঁর ছোটভাই সৈয়দ আতাউর রহমানের হারামের প্রতি ঘৃণা এবং হালালের প্রতি আকর্ষণই তাঁকে এই ব্যবসায় যেতে বাধ্য করেছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের দিকে বার্মিংহামের বোলসালহিথ রোডের ১৪২ নাম্বার ঘরে ছিলো তাদের হালাল গোসারীর দোকান। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই দোকানের উপরে ছিলো বার্মিংহামে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের কেন্দ্র। এই সময় তাঁর বড়ভাই সৈয়দ আব্দুর রহমান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরির সাথে গোটা বৃটেন সফর করেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে সমর্থন ও অর্থ সংগ্রহে। ২৮ মার্চ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ একশন কমিটির উদ্যোগে বার্মিংহামের স্মলহিথ পার্কে যে জনসভায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো হয়েছিলো তা ছিলো বহিবিশ্বে প্রথম খোলা আকাশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ানো। সেই জনসভায় সৈয়দ আতাউর রহমান তাঁর বড়ভাইয়ের নেতৃত্বে অংশগ্রহণ করেন এবং পাকিস্তানিরা আক্রমন করলে তারা প্রতিরোধ করেছিলেন। সেদিন পাকিস্তানিদের আক্রমনের্ ১৩জন বাংলাদেশী আহত হয়েছিলেন। ‘একশন কমিটি ফর বাংলাদেশ লিবারেশন মুভমেন্ট’-এর তিনিও একজন সদস্য ছিলেন। এই সংগঠনের দায়িত্ব ছিলো, একদিকে বৃটেনে জনসমর্থন আদায় এবং অর্থ সংগ্রহ, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা। জেনেভা থেকে ব্যারিস্টার নিয়োগ করতে তারা তাঁর বড়ভাই সৈয়দ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ১৬শ পাউন্ড সংগ্রহ করে তৎকালিন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের সেক্রেটারী রেজাউর রহমানের কাছে দেন। এই টাকা দিয়েই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য জেনেভা থেকে প্রথম ব্যারিস্টার নিয়োগ করা হয়। এরপর তাঁর বড়ভাই সরাসরি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছে ৫০৪ পাউন্ডের এশটি চেক দেন, যা তৎকালিন বাংলার বাণী পত্রিকায় ছবি সহ প্রকাশ হয়।
সৈয়দ আতাউর রহমানের জন্মগ্রাম সৈয়দপুর অতীতকাল থেকেই আলেম-উলামাদের রাজনৈতিক কিংবা ফিকহি মতাদর্শে উজ্জিবিত একটি গ্রাম। এই গ্রামের প্রায় সকল মানুষ বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভিক্ত থাকলেও ইসলামী চিন্তায় দেওবন্দী। সৈয়দ আতাউর রহমানের পরিবারও এ থেকে ভিন্ন নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিপাহসালার মাওলানা সৈয়দ হোসাইন আহমদ মাদানী (র.)-এর খলিফা মাওলানা লুৎফুর রহমান শায়খে বর্ণভী (র.)-এর। শায়খে বর্ণভীর হেফাজতে ইসলামের পথধরেই তাঁর ইসলামী আন্দোলনের পথে যাত্রা শুরু। অতঃপর হয়ে যান এপথে নিবেদিতপ্রাণ, ফানায়ে শায়েখ, ফানায়ে উলামা, ফানায়ে রাসুল, ফানাফিল্লাহ। শায়খে বর্ণভী (র.)-এর ইন্তেকালের পর তিনি আরেফবিল্লাহ হাফেজ মাওলানা আকবর আলী দরগার ইমাম সাহেব (র.)-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এই সময় তিনি হাফেজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র.)-এর সফরসঙ্গী হয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে হাফেজ মাওলানা হযরত মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জীহুজুরের নির্বাচন থেকে তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে যান। তিনি বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় শুরার সদস্য সহ সিলেট জেলা কমিটির বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। খেলাফত আন্দোলন ভেঙে শায়খুলহাদিস আল্লামা আজিজুল হকের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিস গঠিত হলে তিনি প্রথমে সংগঠনের জেলা কমিটির সহ-সভাপতি, অতঃপর নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব আদায় করেন। পওে খেলাফত মজলিস ভেঙে দুভাগ হলে তিনি খেলাফত মজলিস ইসহাক-কাদের গ্রুপের সাথে থেকে যান। তিনি জেলার দায়িত্ব, কেন্দ্রীয় শুরার সদস্য এবং কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্যও ছিলেন।
আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান এনজিওদের অপতৎপরতা ও নাস্তিক মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলনের সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন, যার সভাপতি ছিলেন জামেয়া মাদানিয়া কাজির বাজার মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবিবুর রহমান (র.)। আশির দশকে সিলেটের অপসংস্কৃতি প্রতিরোধে গঠিত মুজাহিদ কমিটির তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি। তখন সভাপতি ছিলেন খলিফায়ে মাদানী হাফেজ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র.)। জামেয়া কাসিমূল উলূম দরগাহে হযরত শাহজালাল (র.)-র মাদরাসা, জমেয়া নুরিয়া ভার্থখলা মাদরাসা, জামেয়া আরাবীয়া রানাপিং মাদরাসা’সহ বৃহত্তর সিলেটের অসংখ্য মাদরাসার কার্যকরি কমিটিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আদায় করেন। দীর্ঘদিন তিনি বৃহত্তর সিলেটের কাওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড ‘আজাদ দ্বীনী এদারায়ে তালিম বাংলাদেশ’-এর কার্যকরি কমিটির সদস্যও ছিলেন। বৃটেনে সৈয়দপুর শামসিয়া সমিতির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে তিনি দীর্ঘদিন বিভিন্ন দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রচেষ্টায় সৈয়দপুর গ্রামে শাহ সৈয়দ শামসুদ্দিন জামেয়া ইসলামিয়া হাফিজিয়া দারুল হাদিস বালিকা মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদরাসার জন্য তিনি এবং তাঁর ভাইরা নিজ বাড়ীর কিছু অংশ এবং ছয় কিয়ার ক্ষেতের জমি ওয়াকফ করে দেন। বৃটেনের বার্মিংহাম শহরে প্রতিষ্ঠিত আল-আমিন ফাউন্ডেশন গঠিত হয়েছিলো তাঁর অনুপ্রেরণায়, যা পরবর্তীতে বার্মিংহামের প্রসিদ্ধ আল-আমিন প্রাইমারী এবং আল-আমিন জুনিয়র স্কুল প্রতিষ্ঠা করে।
আলহাজ্ব সৈয়দ আতাউর রহমান ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে বিয়ে করেন সিলেটী নাগরি ভাষার মহাকবি পির মজির উদ্দিনের ছেলে মরমী কবি পির মনফর উদ্দিনের বড় মেয়ে এবং বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ফরীদ আহমদ রেজার বড়বোন বেগম ফৌজিয়া কামালকে। বেগম ফৌজিয়া কামাল যেমন ছিলেন সুন্দরী তেমন ছিলেন মেধাবীও। কৈশোরে তাঁর কবিতা আমীনূর রশীদ চৌধূরী কর্তৃক সম্পাদিত এবং প্রকাশিত তৎকালিন যুগভেরী পত্রিকা এবং মুহাম্মদ নুরুল হক সম্পাদিত আল ইসলাহ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। তাদের দাম্পত্যে মোট চার ছেলে এবং চার মেয়ে। তাঁর বড়ছেলে বিশিষ্ট্য কবি ও গবেষক সৈয়দ মবনু, দ্বিতীয় ছেলে বৃটেন থেকে প্রকাশিত বাংলা ভয়েস পত্রিকার সম্পাদক সৈয়দ নাসির আহমদ, তৃতীয় সৈয়দ ফখর উদ্দিন এবং চতুর্থ সৈয়দ সফির আহমদ। মেয়েরা হলেন, সৈয়দা সফুয়ানা বেগম শেফা, স্বামী হাফিজ মাওলানা সৈয়দ কফিল আহমদ। সৈয়দা তাসলিমা বেগম লিমা, স্বামী মাওলানা অধ্যাপক আব্দুল কাদির সালেহ। সৈয়দা তাহরিমা বেগম, স্বামী আব্দুল মোনাইম খান শাহান। কবি সৈয়দা তানজিনা বেগম, স্বামী সৈয়দ রিয়াদ আহমদ।