সউদীতে বিশ্বের প্রথম কার্বনমুক্ত শহর

সউদী আরব তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নির্মাণ করছে কার্বন নিঃসরণমুক্ত গাড়িহীন এক শহর। আর গাড়ি না থাকায় থাকছে না রাস্তা, থাকছে না কার্বণ নিঃসরণও। দ্য লাইন নামের এ শহরটি পরিচালিত হবে শতভাগ নবায়নযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সরবরাহের মাধ্যমে এবং সংরক্ষিত হবে এর ৯৫ শতাংশ প্রাকৃতিক পরিবেশ। লোহিত সাগরের তীরে তিরানের সমুদ্র উপকূল, মিসর, ইসরাইল ও জর্ডানের সীমানার কাছের সউদীর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিওমে গড়ে তোলা হচ্ছে অত্যাধুনিক শহরটি।

বলা হচ্ছে, খনিজ তেলহীন আগামীর কথা মাথায় রেখেই এ শহরের পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। শহরটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিৎসাকেন্দ্র, বিনোদন ব্যবস্থা, সবুজে ঘেরা খোলামেলা পরিবেশ সবই থাকবে ৫ মিনিটের হাঁটার দূরত্বের মধ্যেই। পাশাপাশি, কারও অবস্থান থেকে শহরের দূরতম স্থানে পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ২০ মিনিট। অবকাঠামো উন্নয়নে খরচ কমানো হবে ৩০ ভাগ এবং পণ্যের গুনগতমান বাড়ানো হবে ৩০ ভাগ। গত সপ্তাহে জ্বালানি-ভিত্তিক অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৭ সালে ভিশন-২০৩০ ঘোষণা করে সউদী সরকার। দেশটি জানিয়েছে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকেই অর্থাৎ আগামী মার্চ মাসের মধ্যেই জিরো কার্বন সিটি ‘দ্য লাইন’ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে এবং শেষ হবে ২০২৫ সাল নাগাদ। ৫শ’ বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পটি ১০৬ মাইল লম্বা। ১০ লাখ মানুষের আবাসন হবে এতে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এ শহরকে কেন্দ্র করে ৩ লাখ ৮০ হাজার কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে। শহরটিকে স্মার্ট সিটি ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
ক্ষমতায় বসেই সউদী যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান খনিজ তেলের ওপর অর্থনৈতিক নির্ভরতা কমাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সম্প্রতি শহরটির ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন তিনি। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আবহাওয়া সঙ্কট নিরসণের পাশাপাশি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রেও বহুমাত্রা যোগ হবে বলে আশা করছে সউদী সরকার। দেশটি আশা করছে, এখান থেকে সউদী জিডিপিতে বাৎসরিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে।
যুবরাজ সালমান দ্য লাইন সম্পর্কে বলেছেন, ‘ইতিহাস ও সভ্যতার ক্রমধারায় দেখা যায় একসময় শহর গড়ে উঠেছিল মানুষকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় একত্রিত (বন্দি) করে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে। এরপর যখন শিল্পবিপ্লব দেখল বিশ্ব, তখন আমরা দেখলাম শহর নিয়ন্ত্রণে গাড়ি, কলকারখানা ও যন্ত্রপাতির আধিপত্য। এ আধিপত্য ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হবে। ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বনদূষণ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ১শ’ কোটি মানুষ বাসস্থান হারাবে। বর্তমানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দূষিত বায়ু সেবন করছে। কারণ, আমরা উন্নয়নের গতিধারায় প্রকৃতিকে ছাড় দিতে নারাজ। আর তাই দূষণের কারণে প্রতি বছর ৭০ লাখ মানুষ মরছে। বছরে লাখ লাখ মানুষ মরছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আমরা কি এ জন্যই বছরের পর বছর ধরে সময় নষ্ট করে অঙ্কের হিসাবে ছুটে চলেছি? সময় এসেছে আগামীর শহরের ধারণা পাল্টে দেয়ার।’
তবে, নিওমের শুরু থেকেই বিতর্ক চলছে। বিশ্লেষকরা এ প্রকল্পকে বাস্তবসম্মত বলছেন না। তাদের মতে, এ প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারবে না। প্রকল্পটি আবহাওয়ার বিষয়ে নীরব, যেখানে এ অঞ্চলে গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেটের আশেপাশে থাকে এবং হাঁটার উপযোগী নয়। যাত্রীদের দ্রততম ২০ মিনিটে দূরতম গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য জাপানের দ্রুততম বুলেট ট্রেনের চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ গতিবেগের প্রয়োজন, যা এখনও পরীক্ষাধীন।
সউদীর সমর্থকরা বিশাল মাপের চিন্তাভাবনার জন্য দেশটির প্রশংসা করছেন। সমালোচকরা এটিকে অসাধারণ প্রকল্পের স্বীকৃতি দিতে নারাজ। কিছু স্থানীয়, যারা এই অঞ্চলে বাস করেন, তারা এই উন্নয়নে উচ্ছ্বসিত। বাকিরা তাদের উচ্ছেদ করার জন্য পুলিশের সাথে সহিংস সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। তবে আপাতত, এ অঞ্চলের পুলিশদের স্থানে রোবট নিয়োগ করা হচ্ছে না এবং তারা গাড়িতে করে পুরানো ধাঁচেই এলাকাটিতে পৌঁছে থাকে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button