অনিবন্ধিত অভিবাসীদেরকেও করোনা ভ্যাক্সিন দেয়া হবে

বৈধতার পক্ষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের আবারও সমর্থন

এমএফএ জামান: ২০২১ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করেনা মহমারীকালীন সময়ে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বৈধকরণে আবারও তার সম্মতি প্রকাশ করলেন। গত ১৮ মার্চ বৃহস্পতিবার ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে করোনা বিষয়ক আলোচনায় সাংবাদিকের এক প্রশ্নোন্তরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বৈধকরণের প্রসঙ্গে বলেন, তিনি সবসময় অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতার দেয়ার পক্ষে। কিন্তু যারা বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত এরকম কাউকে ঢালাওভাবে কাউকে এদেশে বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া হবে না। আবার সাগর পাড়ি দিয়ে দালালের মাধ্যমে এদেশে আসার পথ আমরা বন্ধ করতে চাই। যারা ব্রিটেনে অনেকদিন যাবৎ বসবাস করছে তাদের বৈধতার বিষয়ে আমি সবসময়ই উদারপন্ধি। আর বর্তমান আইনে তাদেরকে বৈধতার ব্যাপারে আমরা কাজ করছি।

অতীতে বরিস জনসন লন্ডন মেয়র থাকাকালীন সময় থেকে কয়েক লক্ষ্য অবৈধ অভিবাসীদের সাধারণ ক্ষমার জন্য তারই দল কনজারভেটিভ পার্টিকে অনুরোধ করে আসছিলেন। পরবর্তীতে তিনি যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন তখন পর্যন্ত তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, অনিবন্ধিত অভিবাসীদেরকে তিনি বৈধতা দিবেন কিন্তু তার দলের অন্যান্য সদস্যদের রাজনৈতিক চাপের ফলে মি: জনসন তার প্রতিজ্ঞা থেকে সরে আসেন। এমনকি ব্রেক্সিট কার্যকর হ্ওয়ার পর অনেকে আশা করেছিলেন মি: জনসন এবং তার হোম অফিস হয়তো একটু সহনুভুতি প্রকাশ করবে অনিবন্ধিত অভিবাসীদের প্রতি। কারণ ব্রেক্সিট প্রচারণার সময় মি: জনসন বলেছিলেন, যারা ব্রিটেনে প্রায় ১২ বছর যাবৎ বসবাস করছে তাদের বৈধতার ব্যাপারে চিন্তা করা হবে। কিন্তু ব্রেক্সিট কার্যকর হওয়ার পর এই বিষয়ে কার্যত কোনো পদক্ষেপই জনসন সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যায়নি।
কনজারভেটিভ সরকারের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামরুন, থ্যারেসা মে’র কঠোর ইমিগ্রেশন পলিসি ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের হাজার হাজার অভিবাসীর জীবনকে প্রায় ধ্বংস করে দিয়েছে। এছাড়া বিদেশী নাগরিকদের সাথে হোম অফিসের বৈরী আচরণ এবং উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারী যা যুক্তরাজ্যের ইমিগ্রেশন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ব্যাপক নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কিন্তু হোম অফিস কয়েক লাখ অনিবন্ধিত লোকদেরকে কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছে, যা এই করোনা মহামারীতে আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।
২০২০ সালে করোনা মহামারীকালীন সময়ে এই দৃশ্যপট দ্রুতই পরিবর্তন হতে থাকে। ২০২০-২১ সালে প্রায় ১ লক্ষের বেশি লোক করোনায় মৃত্যুবরণ করে যা ব্রিটেনে ২য় বিশ্ব যুদ্ধের মৃত্যুর সংখ্যা থেকেও বেশি। করোনায় অনেক ব্যক্তি মারা গেছেন যাদের এদেশে বৈধভাবে থাকার অনুমতি ছিলনা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যখন সবাইকে করোনা ভেক্সিন দেয়া শুরু হলো তখন বেশিরভাগ অনিবন্ধিত অভিবাসীদেরকে ভেক্সিন দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না। এর মূল কারণ তাদের এনএইসএস (ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস) এ স্বাস্থ্য সেবার নেয়ার সরকারী অনুমতি নেই। এছাড়া সম্প্রতি ব্রিটিশ কোর্ট অনিবন্ধিত অভিবাসীদের করোনাকালীন সময়ে এদেশ থেকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে। এই দুই গ্যাড়াকলের মধ্যে পড়ে সরকার অনিবন্ধিত অভিবাসীদেরকে ডাক্তারে যোগ দেয়ার অনুমতি দেয় যেন তারা করোনা ভেক্সিন নিতে পারে। কিন্তু এই নিয়ে তাদের মধ্যে অনেক ভয় কাজ করছিলো যদি তাদেরকে গ্রেপ্তার করে বের করে দেয়া হয়।
হোম অফিসের প্রতিকূল পরিবেশ নীতিগুলি অনিবন্ধিত অভিবাসীদের করোনা টিকা পেতে বাধা দিতে পারে কিনা এই বিষয়টি জানতে চাইলে সম্প্রতি বরিস জনসনের মুখপাত্র বলেছেন, করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে আমরা কারো ইমিগ্রেশন অবস্থাকে দেখবো না, সুতরাং যারা এখানে অবৈধভাবে আছেন তারা এগিয়ে আসতে পারেন। আমরা যুক্তরাজ্য জুড়ে ভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হ্রাস করতে সংকল্পবদ্ধ।
সরকারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, অভিবাসন অবস্থা নির্বিশেষে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী প্রত্যেককে করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেওয়া হবে। সেইসাথে যারা জিপিতে নিবন্ধভুক্ত নন তাদেরকেও এই ভ্যাকসিন সরবরাহ করা হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করার জন্য অংশীদার এবং বাহ্যিক সংস্থার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রায় ১৩০ টিরও বেশি দাতব্য সংস্থা এবং শরণার্থী সংস্থা প্রায় ১.৩ মিলিয়ন ভিসা বিহীন মানুষকে করোনার প্রকোপ থেকে রক্ষায় টিকা দেয়ার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে।
গত জানুয়ারিতে দ্যা জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্যা ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্র্যান্টসের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ অনিবন্ধিত অভিবাসী এনএইসএস এর সাথে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করতে ভয় পায়। জেসিডব্লিউআইয়ের প্রধান নির্বাহী সাতবীর সিং বলেছেন, কনজারভেটিভ সরকারের অভিবাসী, শরণার্থী এবং অশেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের সাথে আস্থা তৈরির ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল রেকর্ড রয়েছে।
বিলেতে প্রায় কয়েক লক্ষাধিক অনিবন্ধিত অভিবাসী বিগত কয়েক দশক ধরে বসবাস করছেন। যাদের বেশির ভাগেরই কাজ এবং সাধারণ জনগণের মতো সুবিধা ভোগের সুযোগ নেই। এদের মধ্যে অনেকেই তাদের পরিবার-সন্তান নিয়ে খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। যেহেতু তাদের কাজের কোনো সুযোগ নেই তাই অনেকের পক্ষে হোম অফিসের ভিসা আবেদনের ফিস দেয়ার সামর্থটুকু নেই। এই দেশের দীর্ঘ জীবনে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিভিন্ন কারণে তাদের পক্ষে নিজ দেশে ফেরত যা্ওয়ার সুযোগ নেই, আবার বিলেতেও থাকার সুযোগও পাচ্ছেন না। আর ২০২০ সাল থেকে তাদের জীবন আরোও কষ্টের হয়ে দাড়িয়েছে মহামারী করোনার কারণে।
কনজারভেটিভ সরকারের ইমিগ্রেশন পলিসি সবসময় ইমিগ্রেশনের বিপক্ষে। কিন্তু ১৯৭২ সালে প্রায় ২৭,০০০ এশিয়ানদেরকে যখন উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ইদি আমিন বের করে দেয় তখন তৎকালীন বিলেতের টোরী সরকার এদেরকে শরণাথীকে হিসেবে থাকার সুযোগ দেয়। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন সম্প্রতি প্রায় ১ মিলিয়ন লোককে হংকং থেকে বৃটেনে বসবাসের সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু যারা এই দেশে বসবাস করছে প্রায় ১০-১৫ বছর ধরে তাদের বৈধকরণে এখন পর্যন্ত কোনো দিক নির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে আসে নাই।
ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন আইন বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, আমরা সবসময় আশাবাদী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বৈধকরণে বিশেষ ভূমিকা পালন করবেন কারণ তিনি সবসময় অভিবাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই কয়েক লক্ষাধিক অনিবন্ধিত অভিবাসীদেরকে বের করে দেয়া শুধু অসম্ভবই নয় বরং জনগণের টেক্সের টাকার অপব্যয় ছাড়া আর কিছু নয়। হোম অফিস সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ এই সমস্যা সমাধাণে। বরং এদের মধ্যে যারা সৎ এবং ভালো তাদেরকে বৈধভাবে বসবাস ও কাজের সুযোগ দিলে দেশ লাভবান হবে কারণ তারা আমাদের সবার মতো মানুষ। আর ব্রিটেন সবসময় মানবতার পক্ষে কাজ করে আসছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লন্ডন মেয়র থাকাকালীন সময় থেকে এই বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি। আর এইসব মানুষদের কষ্ট খুবই বেদনাদায়ক। তবে আমরা সেইসব ব্যক্তি এবং পরিবারকে সঠিক আইনী পরামর্শ নেয়ার আহবান জানাবো। অনেকে প্রতারক, দালালের মাধ্যমে মিথ্যা-ভূয়া কাগজপত্র ভিসা অফিসে জমা দিয়ে প্রতারিত হয়েছেন।
তাই আমরা সবসময়ই আশাবাদী অনিবন্ধিত অভিবাসীদের বৈধতার ব্যাপারে। কারণ বিশ্বে আজ পর্যন্ত যা সফল হয়েছে তা কিন্তু আশাবাদী মানুষের দ্বারাই সম্ভব হয়েছে কারণ তারা বিশ্বাস করেন এটা হবেই একদিন। এজন্যই কবি নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,
ইহা আল্লাহর বাণী, মানুষ যাহা চায় তাহা পায়,
পূর্ণ পরম বিশ্বাসী হও, যাহা চাও পাবে তাই,
তাহারে ছুঁয়ো না, সেই মরিয়াছে, বিশ্বাস যার নাই…

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button