বিশ্বরেকর্ড করলেন সোহাগ
ইশতিয়াক পারভেজ: অসাধারণ। অনন্য। অতুলনীয়। কোন বিশেষণেই বিশেষায়িত করা যাবে না এমনই এক কৃতিত্ব গড়লেন সোহাগ গাজী। পটুয়াখালীর সোহাগ এখন ক্রিকেট কিং। আগের দিন হার না মানা শত রান হাঁকিয়ে ক্রিকেটের ময়দানে ছিলেন গাজী। আর কালকের কৃতিত্বটা যেন সোনায় সোহাগা। বিশ্ব ক্রিকেটে আরও একজন তারকা পেলো বাংলাদেশ। একই খেলায়, সেঞ্চুরি, হ্যাটট্রিক ও পাঁচ উইকেট- ইতিহাসে বিরল একটি ঘটনা। আর টেস্টে তো নেই-ই। ১৮৭৭ সালে শুরু হওয়া টেস্ট ক্রিকেটের ১৩৬ বছরের ইতিহাসে এমন কৃতিত্ব আর দেখেনি বিশ্ব। প্রায় দেড় শ’ বছরের টেস্ট ইতিহাসে যা কেউ কখনও ভাবেনি তাই করে দেখালেন বাংলাদেশের সোহাগ গাজী। আগের দিনই শত রান করে বাহবা কুড়িয়েছেন সবার। কে জানতো আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে। রোববার দুপুরের বিরতির পর হঠাৎই দৃশ্যপটে আবির্ভাব তার। লাঞ্চের আগেই দুই উইকেট নিয়েছিলেন। এরপর আরও চারটি। এর মধ্যে পরপর তিন বলে তিনটি। পুরো ক্রিকেট বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন তিনি। প্রথমে হ্যাটট্রিক ও পরে ছয়টি উইকেট নিয়ে চৌকস নৈপুণের নতুন নজির গড়লেন এই অফ স্পিনার। তার নৈপুণ্যের জোরে বাংলাদেশ আরেকটি টেস্ট ড্র করতে সক্ষম হলো। ১০ টেস্টে এটি নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ড্র। চতুর্থ দিন পর্যন্ত নয় শুধু, কাল সকাল পর্যন্তও ম্যাচের নায়ক মনে হচ্ছিল ১৮১ রান করা মমিনুলকে। কিন্তু শেষ অবধি আলোর পুরোটাই কেড়ে নেন সোহাগ।
ঘটনাপ্রবাহ- ১২টা ৩৬ মিনিট, ৮৪.২ ওভার- সোহাগের বলে আউট এন্ডারসন। ১২টা ৪০ মিনিট ৮৪.৩ ওভার- এবার সোহাগের শিকার প্রথম ইনিংসে শত রান করা ওয়াটলিং। ১২টা ৪১ মিনিট, ৮৪.৪ ওভার- এবার সোহাগের বলে ডগ ব্রেসওয়েলের বিদায়। -হ্যাটট্রিক! উল্লাসে মাতোয়ারা, গোটা মাঠ, গ্যালারি এবং সারা দেশ। বাংলাদেশের হয়ে দ্বিতীয় আর বিশ্বের ৪০তম টেস্ট হ্যাটট্রিক করলেন সোহাগ গাজী। টেস্ট সাদা পোশাকের খেলা। কিন্তু সেখানেও যে রঙ ঢালা যায় তা দেখিয়েছেন বিশ্বের অনেক ক্রিকেটার। ব্যাট-বলে নানা রেকর্ড গড়ে টেস্ট ক্রিকেটের শত বর্ষের ইতিহাসকে আলোকিত করেছেন নানা রঙে। কিন্তু সে সব রঙকে ছাপিয়ে নতুন আলো ছড়িয়ে ইতিহাসে প্রবেশ করলেন সোহাগ গাজী। তার কীর্তির সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় বাংলাদেশও। স্যার ইয়ান বোথাম, স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্স, কপিল দেব, রিচার্ড হ্যাডলি, ইমরান খান, জ্যাক ক্যালিস কিংবা ওয়াসিম আকরাম খানরা যে কীর্তি গড়তে পারেননি সেই অসাধ্য করেছেন এই তরুণ। এখানে সোহাগ এক ও অদ্বিতীয়। সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম জহুর আহম্মেদ স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ এখন ক্রিকেটের পরিসংখ্যান বইয়ে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে অনেক, অনেক দিন।
সোহাগ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বোলার যিনি এক ইনিংসে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন সেই সঙ্গে নিয়েছেন ৫টিরও বেশি উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে সর্বশেষ এই কীর্তি করেছেন সাকিব আল হাসান। তিনি ২০১১ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে ১৪৪ রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি ৬ উইকেট নিয়েছিলেন ৮২ রান খরচায়। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে এটি ২৯তম ঘটনাও। প্রথম ইনিংসে নিয়েছিলেন ২ উইকেট, পরে ব্যাট হাতে অপরাজিত ১০১ রান এবং এরপরই গতকাল ৭৭ রানে নিলেন ৬ উইকেট।
তবে সোহাগ গতকাল যে ইতিহাসের জন্ম দিয়েছেন তা প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও বিরল। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে আড়াই শ’ বছরের ইতিহাসে এ কীর্তি ছিল ১২ বার। তার মধ্যে উপমহাদেশের একজনই আছেন তালিকায়। ১৯৪৬-৪৭ এর মওসুমে ভারতীয় ক্রিকেটার বিজয় মার্চেন্ট এই কীর্তি গড়েছিলেন। তবে ২০১২ সালের অক্টোবরে সোহাগ গাজী উপমহাদেশে দ্বিতীয় আর বিশ্বে ১৩তম ক্রিকেটার হিসেবে প্রথম শ্রেণীর খেলায় সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিক করার নজির স্থাপন করেন। গত অক্টোবরের জাতীয় লীগে খুলনার বিপক্ষে খুলনার মাটিতে বরিশালের হয়ে ৯৩ বলে ১১৯ করার পর বল হাতে ৭ উইকেট নেয়ার পথে হ্যাটট্রিক করেছিলেন। তখন তিনি জায়গা করে নিয়েছেন প্রথম শ্রেণীর ইতিহাসে। তবে এবার আলো ছড়িয়ে দিলেন আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্রিকেটের কুলীন আসরেও।
প্রথম শ্রেণীর ম্যাচে ১৮৮৪ সালে জর্জ গিফেন ইংল্যান্ড সফরে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে ১১৩ রান করেন। ৫৫ রানে নেন ৬টি উইকেট এবং তিনি হ্যাটট্রিকও করেন। আর সোহাগ গাজীর আগে নিউজিল্যান্ডের অলরাউন্ডার জেমস ফ্রাঙ্কলিন ২০০৯ সালে কাউন্টিতে গ্লস্টাশায়ারের হয়ে।
সোহাগ ক্রিকেট ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই স্বপ্ন দেখতেন অলরাউন্ডার হওয়ার। শুধু বলেই নয়, ব্যাটেও আলো ছড়াতে চান সমান ভাবে। শনিবার সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর মানবজমিনকে বলেছিলেন, ‘ভাল আলরাউন্ডার হওয়ার পথে এক ধাপ এগিয়েছি মাত্র।’ আর গতকাল এমন বিরল কীর্তি গড়ে তিনি কতটা এগিয়ে গেছেন তা ক্রিকেট পরিসংখ্যানের বই-ই তার প্রমাণ দেবে।