ডিজিটাল মুদ্রার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ
ক্রিপ্টো মার্কেটে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের দরপতন
চীনে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত
বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা ও সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে বড় ধরনের দরপতনের মুখে পড়েছে ডিজিটাল মুদ্রাভিত্তিক ক্রিপ্টো মার্কেট। ফলে বাজারে প্রচলিত ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলোর দর কমেছে আগের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে। এমন অবস্থায় ক্রিপ্টো মার্কেটে বিনিয়োগ করা নিয়ে শঙ্কায় আছেন অনেক বিনিয়োগকারী। অনেকে আবার শিগগিরই এর উত্থানের সম্ভাবনাও দেখছেন।
টালমাটাল এমন পরিস্থিতিতে বুধবার ক্রিপ্টো মার্কেটের বৈশ্বিক বাজারদর কমেছে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার, যা এক সপ্তাহ আগেও ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ছিল। বৈশ্বিক ক্রিপ্টো মার্কেটের ৪০ শতাংশের প্রতিনিধিত্বকারী বিটকয়েনের দাম ৩০ শতাংশ কমে বিটকয়েন প্রতি ৩০ হাজার ডলারে পৌঁছেছে, যা জানুয়ারির পর থেকে সর্বনিম্ন। এর পরই শুক্রবার সামান্য দর ফিরে পেয়েছে বিটকয়েন। এদিন প্রতি বিটকয়েনের দাম বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৩৭ হাজার ডলারে। ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ক্রমাগত উদ্বেগের ফলে এমন মূল্য হ্রাস পেয়েছে বলে মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের। এর এক মাস আগেও প্রতি বিটকয়েনের দাম ছিল ৬৪ হাজার ডলার।
নতুন শুরু হওয়া ডিজিটাল মুদ্রার বাজারে বর্তমানে অস্থির অবস্থা চললেও এক বছর আগে অপেশাদার ও নিয়মিত বিনিয়োগকারীদের জন্য দ্রুত মুনাফা অর্জনে একটি আকর্ষণীয় খাত ছিল ক্রিপ্টোকারেন্সি মার্কেট। ফলে শুরুতে দ্রুতই জনপ্রিয়তা ও মূল্য পেতে থাকে ডিজিটাল মুদ্রাগুলো। এর মধ্যে অনেকেই এর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার জন্য বিনিয়োগ করেছেন এবং পরে লোকসানের মুখোমুখি হয়েছেন।
বুধবার অস্বাভাবিক এ মূল্যহ্রাসের আগে থেকেই এক সপ্তাহ ধরে ক্রিপ্টো মার্কেটের অবস্থা অনেকটা নড়বড়ে ছিল। চলতি সপ্তাহে বিভিন্ন কারণে এবং ক্রিপ্টো মার্কেটের নীতিমালা নিয়ে সরকারের সতর্কতামূলক নির্দেশনা এবং ক্রিপ্টো মার্কেটের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তি ইলোন মাস্কের টুইটের পর আরো অস্থিরতা দেখা দেয়।
এর আগে বিটকয়েনের মাধ্যমে টেসলার গাড়ি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার পরই ডিজিটাল এ মুদ্রার দাম ১২ শতাংশ কমে যায়। ডিজিটাল মুদ্রা তৈরিতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন নিঃসরণের কারণে জলবায়ু সচেতনতার অংশ হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত নেন মাস্ক। এছাড়া বিটকয়েন নিয়ে মাস্কের পরস্পরবিরোধী কিছু টুইট বিনিয়োগকারীদের বেশ অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে।
এরই মধ্যে চীনে ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দেয়ার পর বুধবার সবচেয়ে বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে ডিজিটাল মুদ্রার বাজারে। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকগুলোর প্রতি যেকোনো ধরনের সেবার বিনিময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সিতে মূল্য গ্রহণ করতে নিষেধাজ্ঞা দেয় চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এমন সতর্কতার পর স্বাভাবিকভাবেই ক্রিপ্টো মার্কেটে তৈরি হয়েছে নানা অস্থিরতা। বিটকয়েনসহ অন্য ক্রিপ্টোকারেন্সিগুলো ব্যাপক দরপতনের মুখে পড়েছে। ইথোরিয়ামের দাম আগের তুলনায় কমেছে অন্তত ৪০ শতাংশ, ডোজকয়েন ও বাইনান্সের দাম কমেছে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত।
বৃহস্পতিবার কিছুটা ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছে ক্রিপ্টো মার্কেটের অন্যতম প্রতিযোগী বিটকয়েন। ফলে ডিজিটাল এ মুদ্রার দাম পৌঁছেছে প্রতি বিটকয়েন ৪১ হাজার ডলার। তবে শুক্রবার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে চীনের নিষেধাজ্ঞার পর আবার আগের অবস্থানে ফিরে গেছে বিটকয়েনের দাম। এদিন দুপুরের পর থেকে প্রতি বিটকয়েনের দাম দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ডলার। অন্যান্য ডিজিটাল মুদ্রার দামও কমেছে অনেকটাই।
অনেক আগে থেকেই ক্রিপ্টো মার্কেটের ওপর চীনের নানা নিষেধাজ্ঞা ছিল। এর আগে দেশটি ঘোষণা দেয় ক্রিপ্টোকারেন্সি কোনো আসল মুদ্রা নয় এবং যেকোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এটির ব্যবহার করা যাবে না। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। তবে শুক্রবারের এমন বিবৃতি ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে দেশটির নেতিবাচক মনোভাব স্পষ্ট করে তোলে। যদিও ডিজিটাল মুদ্রার বাজারে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতেও যথেষ্ট সচেতনভাবেই পদক্ষেপ নিচ্ছে তারা। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নতুন ডিজিটাল ইউয়ান চালু করেছে দেশটি। একই সঙ্গে এর মুদ্রাপ্রবাহ কড়া নজরদারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বৃহস্পতিবার ফেডারেল রিজার্ভ চেয়ারম্যান জোরেমি পাওয়েলও অর্থনৈতিক খাতে ক্রিপ্টোকারেন্সির সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পলওয়েল বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চলতি গ্রীষ্মের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা উন্নয়ন ব্যবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করা উচিত।
মার্কিন রাজস্ব বিভাগও এরই মধ্যে ক্রিপ্টো মার্কেটের দিকে নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। বৃহস্পতিবার রাজস্ব বিভাগ জানায় ১০ হাজার ডলার বা তার বেশি মূল্যের ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বিভাগকে বাধ্যতামূলকভাবে অবগত করতে হবে।
চলতি সপ্তাহের এ টালমাটাল পরিস্থিতি ক্রিপ্টো মার্কেটের সত্যিকার বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি বিশ্বস্ততা প্রমাণের সময়। আসল বিনিয়োগকারীরা এক ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে তাকিয়ে আছেন। গত বছরের শুরুর দিকে প্রতি বিটকয়েনের মূল্য যেখানে ৭ হাজার ডলার পরিমাণ ছিল, বর্তমানে তা দরপতনের পরও সেই সময়ের চেয়ে ৪০০ শতাংশ বেশি রয়েছে।
ক্রিপ্টোকারেন্সিভিত্তিক একটি বিনিয়োগ তহবিলের কর্মকর্তা উইলিয়াম কুইগলি বলেন, আমরা প্রতিদিন প্রতি সপ্তাহে এর ওপর পর্যবেক্ষণ অব্যাহত রাখি। তবে অধিকাংশ লোকই এমন পরিস্থিতিতে ক্রিপ্টোকারেন্সি ক্রয় বা সঞ্চয় করবেন না। তবে কি ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি বাবল এমন প্রশ্নের জবাবে ইথোরিয়ামের সহ-তৈরিকারক ভাইটালিক বুটারিন এমন সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেন না। তিনি জানান, সাম্প্রতিক এমন দরপতনে তিনি মোটেও বিস্মিত হননি। কারণ তিনি এর আগে এমনটা দেখেছেন।